চার দুগুণে ছয়/হামিদ আহসান

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আসগর কবির চাকলাদার দৌড়াচ্ছেন হেলেদুলে মেদবহুল শরীরটাকে টেনেটুনে। আগে আগে দুলছে তার অনেক সাধের ভূঁড়িটা। বাসার কাছাকাছি আমাদের সেক্টরের পার্কে কখনও-সখনও সকালবেলা হাঁটতে যাই। সকাল-সকাল গেলেই দেখি আসগর কবির চাকলাদারকে; দৌড়াচ্ছেন, হাঁটছেন কিংবা বসে আছেন। সব অবস্থায় সুনামির শিকলটা তার হাতেই থাকে। সেই শিকলের মাথার লৈাহবৃত্তে গলা ঢুকানো সুনামিও দৌড়ায় হয় প্রভুর সাথে সাথে। এইজন্যই হয়ত প্রভুভক্তপ্রাণী হিসেবে কুকুরের অনেক সুনাম। নিজের গলাকে এরকম শেকলে আটকে নিজেকে মর্তে্যর প্রভুরূপী মানুষের হাতে সঁপে দেওয়া জন্য সুনামির ভেতরে কোনো দুঃখবোধ আছে কিনা, সেটা জানার অবশ্য কোনো উপায় নেই। কুকুর বোবা প্রাণী অথবা কুকুরের ভাষা মানুষ বুঝে না! মানুষ তো বাগযন্ত্র থাকা সত্তে¡ও এসব ব্যাপারে উচ্চবাচ্চ করে না। 

কুকুরটার নাম যে সুনামি সেটা আসগর কবির চাকলাদার নিজেই আমাকে বলেছেন। কোনো কুকুরের এমন অদ্ভুত নাম আগে কখনও শুনিনি। কুকুরের এরকম নাম রাখার অন্তর্নিহিত কারণ কী হতে পারে, কে জানে! লোকে বলে, ‘আসগর কবির চাকলাদার অবসরপ্রাপ্ত হলেও এখনও পর্যন্ত লাইন ঘাট ধরে রেখেছেন।’ শুনেছি আগের কর্মক্ষেত্রে এখনও তার অনেক প্রভাব; তবে সেটা কীভাবে কে জানে! হয়তো কিছু ব্যাপর আছে, যা আমার জানা নেই। 

তিনি আমার বাড়িওয়ালা ছিলেন। আমার বর্তমান ফ্ল্যাটটা ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে বুঝে পাওয়ার আগে আমি যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলাম, সেটার মালিক তিনি। সেই থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। তার আচরণে স্পষ্টই বুঝা যায়, তিনি আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না, তারপরও কোনো এক অজানা কারণে তিনি আমাকে তার জীবনের অনেক গল্প শুনিয়েছেন। উত্তরাসহ ঢাকা শহরের নানা জায়গায় সাতটি আস্ত বাড়িসহজ তার এমন অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে বলে তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন। মাঝে মাঝে আফসোস করে বলতেন, তিনি যদি নীতিহীন হতেন তাহলে এই ঢাকা শহরে তার আরও অনেক বাড়ি-গাড়ি থাকতে পারতো; নীতির সাথে আপোস করেন নি বলেই তার কিছু হয় নি। 

সুনামি নামের কালো রঙের নাদুস-নুদুস জার্মান প্রজাতির কুকরটা এখন চাকলাদার সাহেবের কিছু না হওয়া জীবনের নিত্যসঙ্গি। সারা গা-মাথা ঘণ কালো লম্বা পশমে ভরা কুকুরটা আমাকে দেখলে তার ছোট ছোট দুটি চোখে পিটপিট করে তাকায়। দেখলেই ভয় ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি লাফ দিয়ে আমার গর্দানে উঠবে। কুকুরটা কোন প্রজাতির সেই নামটাও বলেছিলেন আমাকে আসগর কবির চাকলাদার। আমি ভুলে গেছি। তবে শেফার্ড না। সঙ্গি কুকুর হিসেবে এগুলো নাকি খুব ভালো। এগুলো যেমন প্রভুভক্ত তেমনি নাকি প্রয়োজনে শক্রুর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। 

কুকুরের সাথে তার বন্ধুতে¦র ব্যাপারটা তিনি নিজেই আমকে বলেছেন। কথায় কথায় একদিন বললেন, “সুনামি-ই এখন আমার একমাত্র বন্ধু।”

আমি জানতে চাইলাম, “আপনার মতো মানুষের তো বন্ধুর অভাব হওয়ার কথা না, মানুষ না হয়ে কুকুর কেন আপনার একমাত্র বন্ধু হবে!”

প্রশ্নটা আসলে আমি যে খুব চিন্তাভাবনা করে করেছি তা কিন্তু না; সাধারণ একটা কৌতুহল জেগেছিল মনে। তবে প্রশ্নটা করে আমি ভেতরে ভেতরে কিছুটা কুঁকড়ে যাই। কারণ, আগে একটা প্রশ্ন করে আমি তাঁর রোষাণলে পড়েছিলাম। যখন তিনি বলেছিলেন ঢাকায় তার আরও অনেক ফ্ল্যাট আছে তখন আমি কৌতুহলবশত জানতে চেয়েছিলাম,

“সব ফ্ল্যাট কি আপনার নিজের নামে?”

তখন তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “শুনেন, আমার সাথে চালাকি টাইপ কোশ্চেন করবেন না। আমি চল্লিশ বছর মানুষ চড়িয়ে খাই, আপনার নলেজ আর আমার নলেজ সমান না। আর আপনারা এই যুগের লোকেরা আমাদের মতো অতোটা এক্টিভও হতে পারবেন না। মনে রাখবেন কথাটা।”

আমি মনে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। ভেবেছিলাম তাঁকে আর কখনও কোনো প্রশ্ন করব না। কিন্তু হঠাৎ মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেড়িয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সব থাকা সত্ত্বেও একটা কুকুরই কেন তার বন্ধু হবে সেই ব্যাপারটা বোধহয় আমার অবচেতনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তাই হয়তো মুখ দিয়ে প্রশ্নটি বেড়িয়ে গিয়েছিল। 

‘মানুষ বড় বেঈমান কৌশিক সাহেব!’ আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ন কণ্ঠে উত্তর দিলেন চাকলাদার সাহেব। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যে এবার তিনি রাগ করলেন না। 

“কেন, মানুষকে এরকম গলায় শিকল বেঁধে ঘুরানো যায় না, সেইজন্য কি?” এইবার প্রশ্নটা আমি ইচ্ছে করেই তাকে রাগানোর জন্য করলাম।

সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি উঠে পড়লেন। তার বডি লেঙ্গুয়েজ বলছে, ’এসব মূর্খের সাথে কথা বলাই ভুল। ওহ, এতক্ষণে মনে পড়েছে, সুনামি নামের কুকুরটা জার্মান এফেনপিনশার প্রজাতির। পাশাপাশি যখন হাঁটে ওর চার পা-ই দৃশ্যমান হয় আর আসগর কবির চাকলাদারের দু পা। দুজনে ছয় পায়ে পিল পিল হাঁটে!

মন্তব্য করুন