তালের ডিঙি ।। মালেক মাহমুদ

আষাঢ়ের জল আসতে না আসতেই তালের ডিঙি ঘাটে। অল্প জলে ভেসে থাকে ডিঙি। এই ডিঙি বহুদিনের পুরানো। দুজন চড়া যায় এই ডিঙিতে। তিনজন হলেই ডুবুডুবু। ঢেউহীন জলে বেশ নিরাপদ। সবাই এই ডিঙি চালাতে পারে না। ডিঙি চালাতে হলে শিখতে হয়। সবাইকে চালাতে পারতে হবে, এমনও নয়। এই ডিঙি চালাতে কিছুটা কৌশলি হতে হয়। তালের ডিঙি চালাবেন আর সাঁতার শিখবেনা তা কী হয়?

না, হয় না।

সাঁতার শিখতেই হবে।

সাঁতার না শিখলে, হালকা ঢেউ এলেই হতে পারে বিপদ। সমনে এসে দাঁড়াতে পারে মরণফাঁদ। নদীর ঢেউ ডুবিয়ে দিতে পারে তালের ডিঙি। তবুও নফেল চাচার পারাপারের জন্য তালের ডিঙি ভরসা।

মাঠের সবুজ ধানগুলো জলের সঙ্গে বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। জল বাড়ছে। ধান বাড়ছে। সবুজ রঙে রঙিন হয়ে আছে এক ফসলের মাঠ। সেই গ্রামেই বাস করে নফেল চাচা। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। সাতপাঁচ খুব কমই বোঝেন। সহজসরল জীবনযাপন করেন চাচা। জীবনছবিতে তাই ফুটে ওঠে।

যে ছবিটির কথা বলছি, এই ছবিটি এখন হারিয়ে গেছে। এই যে সড়ক দেখছ, এখন আমরা বসে আছি, এটি ছিল একটি ‘হালট’। যাকে আমরা বলি মেঠো পথ। সেই পথ আষাঢ় এলেই জলে তলিয়ে যেত। এই ‘হালটের’ উপর দিয়ে চলতো ডিঙি নৌকা। বর্ষাকালে নাও ছাড়া হাটে বাজারে যাওয়া যেতো না। বর্ষাকালে কাজ নেই নফেল চাচার। তাই মাছ ধরার জন্য যতো আয়োজন। বর্শি, জাল, চাঁই, টেটা জোগার করে। অবসর সময় কাজে লাগবে। মাছ কখনো কিনে আনেনা নফেল চাচা। ডিঙি নৌকোতে চড়ে ধরে মাছ। সেই মাছ তার ভাতের সুসাদু তরকারি। এক বর্ষায় পানি বাড়ছে তো বাড়ছে। পানি উঠেছে উঠোনে। তবুও পানি কমার নামগন্ধ নাই। ঘরে বসে পানি উপভোগ করছে নফেল চাচা। টেটা দিয়ে ধরছে মাছ। চাচি রান্না করছে। তিনজনের সংসার। সুখের সংসার বলতে পারি। সুখ যে কখন হারিয়ে যায়। কীভাবে হারিয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না।

সময়ের ধারাবাহিক পরিবর্তেনে হারিয়ে গেছে নফেল চাচার ডিঙি। যেভাবে হারিয়ে গেছে গুণটানা নৌকো। গুণ ধরে টানলেই নৌকো চলে। না টানদিলে আর নৌকা চলে না। সেই সময় নফেল চাচার কোনো নাও ছিল না। ছিল একটি তালের ডিঙি। এই ডিঙি নৌকা ছিল এক মাত্র ভরসা। আষাঢ় এলেই থৈথৈ জলে ভরে যেতো মাঠ। বাড়ি থেকে বের হতে চাই নৌকা। ভাসমান বাহন ছাড়া বাজারঘাটে যাওয়ার কোনো পথ নেই। নৌকা কিনবে এমন অর্থ নাই নফেল চাচার। দিন আনে দিন খায়। এক টুকরো জমি আছে বটে। সেই জমি চাষও করে। নিজের হাতে পাকা ধান কাটে। সেই ধানের অর্ধেকের মালিক হয় জমির। এ এক করুণ ইতিহাস। নাখেয়ে ঢেকুর তোলার মতো ইতিহাস। নফেল চাচার। সে একজন কর্মী মানুষ বটে। কর্মই তার কাজের মূল শক্তি। নফেল চাচার কথাগুলো এখন শুধু স্মৃতি।

চাচা কাটা ধানগুলো নিজে মাথায় করে দিয়ে আসতো জমিরের বাড়ি। শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়ে মাটিতে। জমিরের বউ ধান দেখে মিটিমিটি হাসে। হাসি নাই, নফেল চাচার। ঘামই যেন নফেল চাচার একমাত্র পথচলার সঙ্গী। নিজের হাতে ফলানো ফসল, দিয়ে হয় জমিরের বাড়ি। কাজ যেনো তার জীবনসঙ্গী মাত্র। বয়স যতোই বাড়–ুক। কাজ তাকে করতেই হবে। জীবন চালাতে কাজের বিকল্প আর কিছু নেই। কাজ করে যে ফসল পায় তাতে সংসাই চলে টেনেটুনে। নফেল চাচার একটি মেয়ে, নাম লাইলি। বড়ো আদরের মেয়ে। সেই মেয়ে এখন শশুরবাড়ি।

ছোট্ট লাইলি কীভাবে যে বড়ো হয়ে গেল!

কীভাবে বিয়ে হয়ে গেল!

ভাবতে গেলে চোখে জল চলে আসে। চোখের জল যেন নফেল চাচার জন্যই বরাদ্দ।

আদরের মেয়ে দেখতে দেখতে বড় হয়ে যায়। সারা গ্রাম যে মেয়ে চষে বেড়াতো। যখন মাঠে কাজ করতো নফেল চাচা, সকালের খাবার নিয়ে যেতো লাইলি। কাটা ঘাসগুলো নিয়ে আসতো বাড়িতে। ফাঁকে ফাঁকে স্কুলে যায়। পাঁচ ক্লাস পাস দিয়েছে মেয়ে লাইলি। এ ভেতরেই মানুষের কানাঘোষা শুরু হয়ে যায়। ঘটক ভালো ছেলে নিয়ে হাজির। অভাবের সংসারে মেয়ের বিয়েতে টাকা জোগার করা খুব কঠিন। তবুও, আদরের ্একমাত্র মেয়ে বিয়ে দিয়েছে।

মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় এককাড়ি টাকা কীভাবে জোগার হলো?

কোথায় পেলো এতো টাকা?

টাকা ছাড়া কী মেয়ের বিয়ে হয়েছে?

না, হয় নাই।

তা হলে কোথায় পেলো এতো টাকা?

এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে, চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে।

আদরের মেয়ের সুখের জন্য, তখনি এই ধানি জমি বন্ধক রেখে টাকা আনেন নফেল চাচা। জমিরের কাছ থেকে এনেছিল টাকা। জমির ঢাকা থাকে। জমি চাষ করবে সেই সময় তার নাই। তাই তার কাছেই জমি বন্দক রাখে নফেল চাচা। মনের দুঃখ মনে চাপা রেখে জমি চাষ করে চাচা। এই জমি বন্দক রেখে যে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছিল সেই মেয়ের ঘরে যে সুখ আছে এতেই নফেল চাচা সুখী। সুখ একটি আপেক্ষিক বিষয়। কে যে কোন বিষয় সুখ পায় তা অনুধাপন করা কঠিন। তাদের সুখের সংসার। নফেল চাচা এতেই সুখী। জমি ছাড়িয়ে নিবে সেই টাকা তার নেই। এদিকে গায়ের শক্তি তার কমে আসছে। এখন সে জমি চাষ করার শক্তি সে হারিয়ে যাচ্ছে। জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে চাচা হেরে গেল। চলে গেলেন নাফেরার দেশে।

নেই তার তালের ডিঙি। এখনো আছে তার বাড়িটি। পাশদিয়ে চলে গেছে পাকাসড়ক।

০১৯১২২৩৮১৮৭