‘হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান, হিফজুর!’

পর্ব-১

হিফজুর রহমান ।।

[শুরুতেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, এই গল্পগুলো একটা অনিশ্চিত যাত্রা নিয়ে চলেছে। হঠাৎ করেই অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নবাসী এবং ১৯৮১-৮২ সালে বাংলার বাণীতে আমার সহকর্মী শরীফ আস সাবেরের উৎসাহে ফেসবুকে একদিন আমার সাংবাদিকতা জীবনের কিছু কথা লিখে ফেললাম। তারপর অনলাইন পত্রিকা দেশ-এর সম্পাদক সালেহ ভাইয়ের অনুরোধে ওই লেখাগুলো দেশ-এ প্রকাশ করতে রাজী হলাম; কিন্তু ফেসবুকে দেয়ার ব্যাপারেও অনড় থাকলাম। সালেহ ভাই বললেন, রবি ও বুধবার ‘দেশ’ পত্রিকায় এবং সোম ও বৃহস্পতিবার ফেসবুকে প্রকাশিত হবে।’ তার কথায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারপর বিশেষ কারণে দেশ অনলাইনকে ছাড়তে হলো। তবে ‘অল্প স্বল্প গল্প’ ফেসবুকে অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করছিলাম। ফেসবুক ও দেশ-এ লেখাগুলো পড়ে লেখক ও প্রকাশক নাসির আহমেদ কাবুল তার সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘আজ আগামী’-তে প্রকাশের অনুরোধ করলেন। সেই সঙ্গে তার জলছবি প্রকাশন থেকে গল্পগুলো ২০২১ বইমেলায় বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অল্প স্বল্প গল্প বই আকারে প্রকাশ করার স্নেহধন্য কাবুলের আগ্রহকে অগ্রাজ্য করার সাধ্য আমার ছিল না। কারণ ওর সাথে সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের এবং ভালোবাসারও। গল্প অনেকগুলোই লেখা হয়ে গেছে। আর কয়েটা লেখা লিখব, বইটা ভরাট করার জন্যে। পাঠকের ভালো লাগলে প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো।]


১৯৯৭ সাল। আমি তখন অস্ট্রেলীয় দূতাবাসের পলিটিক্যাল/ইকনমিক অফিসার। সে সময়ে ফ্যমিলিয়ারাইজেশন ট্রিপে প্রায় দেড় মাসের জন্যে অস্ট্রেলিয়া যেতে হয়েছিল। অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ডিপার্টমেন্ট অভ ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) আমার সফর ও প্রশিক্ষণসূচি ঠিক করে দিয়েছিল ক্যানবেরা, সিডনি ও মেলবোর্নে। সিডনি ও মেলবোর্নে কিছু মিটিং এবং ক্যানবেরায় ডিপার্টমেন্টের প্রশিক্ষণ নির্ধারিত হয়।
ক্যানবেরা থেকে সিডিনি- সিডনীতে প্রচুর দৌড় ছিল। এর মধ্যে শেষদিন ছিল হোম বুশ বে তে সিডনি অলিম্পিক সাইট দেখতে যাওয়া। সন্ধ্যের প্লেনে ফেরার কথা ক্যানবেরা। অলিম্পিক সাইটে প্রায় সারাদিনের কর্মসূচি। অত বড় সাইট দেখার জন্যে সময়ও তো লাগে প্রচুর। একটা ব্যাটারি-চালিত গাড়িতে করে এক গাইড ভদ্রমহিলা আমাকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। দুপুরের একটু পরেই ফিরলাম সিডনি, হোম বুশ বে থেকে ট্রেনে করে। পাঁচতারকা কিংসক্রস বেজওয়াটার হোটেলে ছিল নিবাস। হোটেলে ঢুকতে না ঢুকতেই রিসেপশন কাউন্টার থেকে আমাকে জোরেশোরে ডাকতে লাগল। একটু বলে নেয়া দরকার, অস্ট্রেলিয়ায় ডিএফএটি’র অফিসারদের মর্যাদা ছিল অনেক। হোটেলে আমার পরিচয় ছিল, অফিসার-ডিএফএটি। আর বুকিং ছিল স্যুইটে। ফলে হোটেলে খাতির ছিল আরও বেশি।
তাড়াতাড়িই গেলাম কাউন্টারে। দেখি বেশ কয়েকটা ফোন এসেছে ক্যানবেরা থেকে; আমার সুপারভাইজর রস পাঠিয়েছে। প্রত্যেকটার বাণী একটিই, হোটেলে ফিরেই চটজলদি ফোন করো। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করলাম রসকে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, ক’টায় ফ্লাইট আমার। আমি বললাম সন্ধ্যে সাতটায়। ও বলল, না এখনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উড়াল দাও। আজ সন্ধ্যে সাতটায় জন্য ফাহরম্যান তোমাকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে। আমি তোমাকে সাড়ে ছয়টায় হোটেল থেকে পিক করব। ঘড়ি দেখি, পৌনে চারটা। আমি রসকে বললাম, দেখছি কত আর্লি আসতে পারি। তাড়াতাড়ি বুক করলাম ৫টার ফ্লাইট, গচ্চা গেল ৫ ডলার। এক ঘন্টা লাগবে ক্যানবেরা পৌঁছুতে। সন্ধ্যেয় যাবো বলে কাপড়-চোপড় সব গুছোনোই ছিল। রিসেপশনে একটা ট্যাক্সি ডাকতে বলে উপরে ছুটলাম। জিনিসপত্র নিয়ে নামলাম নিচে। একটু অবাকও হলাম। আমি ভাবতেই পারিনি, জন ফাহরম্যান সত্যিই আমার সঙ্গে দেখা করবে, তাও ডিনারে!
ছ’টায় নামলাম ক্যানবেরা। হোটেলে ৬-২০। দশ মিনিটের মধ্যে স্যুটেড-বুটেড হয়ে গেলাম। তখন স্নোফল চলছে। একটু ঠাণ্ডা। রস এসে পড়ল ঠিক সাড়ে ছ’টায়। আমি নিচে রিসেপশনেই বসেছিলাম। মানুকার রেস্তোরাঁয় এক রকম হামলার মুখে পড়লাম। এক বিশালদেহী অস্ট্রেলিয়ান তাদের সব কেতা ভুলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।


পূর্ব কথা
১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার টিম ফিশার। তাঁর দলে ছিলেন অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের আমেরকিাস অ্যান্ড প্যাসিফিক-এর মহাপরিচালক জন অলিভার এবং টিম ফিশারের উপদেষ্টা জন ফাহরম্যান। তারা উঠেছিলেন তখনকার হোটেল শেরাটনে। ফলে আমাদেরও একটা অফিস বসান হয়েছিল শেরাটনে, সকল প্রকার লজিস্টিকসহ। ওখানে অফিস ম্যানেজার ছিলেন আমার সুপারভাইজর এবং ডেপুটি হাইকমিশনার পিটার ডয়েল, সহকারী অফিস ম্যানেজার, আমি এবং সহকারী আফরিন।
সফরকারী তিনজনই ছিলেন খুব মজার মানুষ। বাইরের প্রোগ্রাম সেরে সোজা এসে বসতেন আমাদের অফিসে। ওখানে অবশ্য একটা বিছানাও ছিল, আমার বা পিটারের রাতে থাকার জন্যে। ভিআইপি’র অনুষঙ্গ বলে কথা! দুইজন আর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার এসেই ধপ করে বসে পড়তেন আমাদের আফিরে সোফায়। তাদের গল্প হত, সঙ্গে তাদের বিয়ার পানও চলত।
একদিন জন ফাহরম্যান একা এসে বসে গল্পে গল্পে বলে ফেললেন, তার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় যৌথবাহিনীর একজন কর্নেল ছিলেন। সেই সময় জন ছিলেন বেশ ছোটো এবং তার খেলনা ছিল সব মাটির হাতি, পাখী-এরকম সব ভারতীয় মোটিফ। ওই খেলনাগুলোর কথা তিনি কখনও ভুলতে পারেন না। উনি যখন ওই কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার কন্ঠস্বর ধরে আসছিল। আমরাও বেশ মজা পাচ্ছিলাম অস্ট্রেলীয় সরকারের অত্যন্ত সিনিয়র একজন কর্মকর্তার নিজস্ব কথাগুলো শুনে।
ওই দিনই বিকেলে টিম ফিশারের মিটিং ছিল তৎকালীর শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। ওই সুযোগে আমি পিটারের কাছ থেকে ঘন্টাখানেকের ছুটি চাইলাম। ও কারণ জানতে চাইলে বললাম, ‘পারসোন্যাল অ্যান্ড সিক্রেট’। পিটার আর কথা বাড়াল না। শুধু তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলল সফরকারীরা ফেরার আগেই।
আমিও তাড়াতাড়িই ফিরে এলাম। আমার হাতে ছিল আড়ংয়ের একটা ব্যাগ। পিটার, আফরিন দুজনেই হইহই করে উঠল, কী ব্যাপার , কী আছে ওতে! নিশ্চয়ই ওদের জন্য কোনও উপহার এনেছি। আমি আবারও বললাম, ‘পারসোন্যাল অ্যান্ড সিক্রেট।’ ওরা আর জ্বালাতন করল না।

ওই দিন রাতে ওদের স্টেট ব্যাংকোয়েট ছিল যমুনায়। ব্যাংকোয়েট সেরে ওরা আবার এসে ঢুকল আমাদের অফিসে। তখন আফরিন চলে গেছে বাসায়। সন্ধ্যের পরে ওকে রাখতাম না। সবাই বসল সোফায় এবং বিয়ার চলতে লাগল। এবার আমি আড়ংয়ের ব্যাগটা খুললাম। প্রথমে একটা করে আঁকাবাঁকা শেপের গ্লাস দিলাম টিম ফিশার আর জন অলিভারকে। আমাদের গ্রামীণ শিল্পীদের তৈরী। তারপর আরেকটা প্যাকেট বের করে না খুলে জন ফাহরম্যানকে ধরিয়ে দিলাম। সে ঝটপট প্যাকেটটা খুলে জিনিসগুলো সেন্টার টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান, হিফজুর!’ সে চট করে উঠে বুকে জড়িয়ে ধরল আমাকে। ওগুলো ছিল সব মাটির খেলনা, যেগুলো দিয়ে জন ফাহরম্যান খেলাধূলা করত, তার ছোট্টবেলার ভারতবাসের সময়। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওগুলোর দিকে। শুধু টিম ফিশারম্যান বলল, ‘হিফজুর, একজন বড় ডিপ্লোম্যাট হতে পারত।’ জন অলিভার আর পিটার ডয়েলও আমাকে ধন্যবাদ জানাল, আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার জন্যে।
তার কিছুদিন পরেই আমার অস্ট্রেলিয়া যাবার কথা। এটা ওরা তিনজনই জানত। জন অলিভারের ওখানে তো কাজই করার কথা। টিম আমাকে বলল পার্লামেন্ট হাউজে ওর অফিসে যাবার জন্যে। সবশেষে জন ফাহরম্যান বলল, ‘তুমি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে আমার সাথে দেখা না করলে তোমাকে আমি হত্যা করব!’ একটু আঁতকে উঠে বললাম, ‘অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে তোমার দেখা পাওয়া তো মুশকিল, তোমার যা অবস্থান!’
জন বলল, ‘ডিএফএটিতে তোমার ডেস্ক অফিসারকে বলবে, আমার অফিসকে শুধু জানিয়ে দিতে, তুমি এখন অস্ট্রেলিয়ায়। বাকিটা আমি দেখব।’ আমি সংকুচিত হয়ে মনে মনে ভাবলাম, এ হবার নয়!
একদিন ডিএফএটিতে কাজ করতে করতে আমার ডেস্ক অফিসার রস-কে বললাম, জন ফাহরম্যানের অফিসকে জানাতে যে, আমি এখন অস্ট্রেলিয়ায়। রস তো প্রথমে আঁৎকে উঠল, ‘জন তোমাকে চেনে? শুধুই হিফজুর রহমান বললেই হবে!’ আসলে ও ঘাবড়ে গিয়েছিল, জন ফাহরম্যানের মত মানুষের অফিসকে শুধু আমার কথা বললেই হবে। আমার এই কথাটা ওর বিশ্বাস না হলেও ও আমার সামনেই জন-এর অফিসে জানিয়ে দিল কথাটা। এরপর কয়েকদিন ছিলাম ক্যানবেরা, তারপর চলে গেলাম সিডনি। মনে হল, আসলে জন ফাহরম্যানের সময় কোথায়, আমার মত ছোট-খাটো (দৈর্ঘ্যে নয়) মানুষের সঙ্গে দেখা করার মতো সময় কোথায়? আসলে ওইদিন অনেক বেশি ইমোশন্যাল হয়ে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের উপদেষ্টা ওই কথা বলে ফেলেছিলেন। মুহূর্তেই ওকে আমি মিলিয়ে ফেলেছিলাম আমার দেশের বড় কর্তাদের সাথে। জানতাম না আমার জন্যে কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে!


সেই প্রথম কথাগুলোয় চলে আসি। আবারও জন ফাহরম্যান উচ্ছ্বসিত। অনেকগুলো ডিশ অর্ডার দিয়ে ফেলল; যেটা সাধারণত অস্ট্রেলিয়ানরা করে না। খাওয়া, পান, গল্প সব চলতে লাগল। সবশেষে কফি। তারপর শুরু হল জন-এর উপহার দেয়ার আতিশয্য। এটাও অস্ট্রেলিয়ানরা কিছুটা করলেও এতটা করে না। প্রায় চার ঘন্টা কেটে গেল এভাবে। তারপর আবার কোলাকুলি জন-এর সাথে এবং বিদায়ের কষ্ট!
বিদায়ের সময় জন অশ্রু ছলছলো চোখে শুধু বলল, ‘হিফজুর, আমি সারা জীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তুমি আমার শৈশব ফিরিয়ে দিয়েছিলে, যা আমি মোটেও ভাবিনি। বিধাতা তোমার ভালো করুন।’ আমারও তখন চোখ চিকচিক করছে।
হোটেলে ফিরেও অনেকক্ষণ স্থানুবৎ বসেছিলাম। প্রায় ২৬ বছর বিদেশিদের সাথে কাজ করেছি, কিন্তু এমনটা কখনও দেখিনি। আজও জন-কে ভুলতে পারি না। আমিও বলি, বিধাতা তোমার সুন্দর মনের জন্যে অনেক পুরস্কার দিন, সুখ দিন।
-হিফজুর রহমান, গবেষক, লেখক এবং উন্নয়ন যোগাযোগ কর্মী। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

মন্তব্য করুন