পাশ্চাত্যে বিবাহনামক ‘সামাজিক চুক্তি’তে পরিবর্তনের হাওয়া/ হুসনুন নাহার নার্গিস

ইউরোপ, আমেরিকা, চিন এবং জাপানের দেশগুলোর বিবাহের চিন্তাধারায় পরিবর্তনের হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। ওইসব দেশগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরছে দিনের পর দিন। এতে নতুন প্রজন্ম দিন দিন আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে।

বিয়ে করতে যাওয়ার আগে মানুষ চিন্তা ভাবনা করতে থাকে বিবাহিত জীবনটা কি আনন্দদায়ক? না তা নয়। এতে জড়িয়ে আছে সংসারের বোঝা টানার জন্য টাকার র‌্যবস্থা থাকা, বিরাট দায়িত্ব টানার জন্য থাকতে হবে শক্তিশালী মন এবং শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা।

’… এবং তারা একে অপরকে পছন্দ করিয়া ফেলিল, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে আরম্ভ করিল’ এই রূপকথার বাক্য আর বাস্তবে খাটে না । লেখক পরবর্তী অধ্যায় লিখে যায়নি ‘তারপরে সুখ শান্তির অবসান হইল” ।

এই ভাবেই হয়তো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। যা চারশত বছর আগে প্রচলিত ছিল সেই নিয়ম কানুন এখনকার সমাজে পুরানো এবং অচল। কিন্তু যখন প্রথম যা কিছুই আরম্ভ হয় না কেন “ জাত গেল জাত গেল “ বলে কানা ঘুষা চলতে থাকে।

যে সব কারণ উত্থাপন হচ্ছে পরবর্তী জেনারেশন দ্বারা :

একটা মেয়েকে পাশ্চাত্য দেশে ছেলেটার মতোই সংসারের সব খরচ ভাগাভাগি করে বহন করতে হয়। আবার তাকেই শিশু গর্ভ ধারণ, জন্ম দান, লালন পালন-সহ পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। দুই দিক সামলানো একজন মানুষের জন্য একটা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । “ দুইজনকেই অর্থ দিতে হবে “ বিষয়টি পাশ্চাত্য দেশগুলোতে প্রাকটিস হয় ।

মেয়েরা এই দুই বোঝা টানার হাত থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছে ।

নতুন আইন: সন্তান হওয়ার পর কোনো কারণে বিয়ে ভেঙে যায় তবে তাদের দুজনের করা বাড়ি ,সন্তান ১৮ বছর হওয়া অবধি মা-সহ থাকতে দিতে হবে এবং সন্তানের ভরণপোষণ চালাতে হবে। এই আইনের কারণে ছেলেরা সংসার করতে ভয় পায় বাড়ি ছাড়া হওয়ার ভয়ে। এই সব দেশে আইন। আইন মানতেই হবে। বিবাহ বিচ্ছেদের হার খুব বেশি । বিচ্ছেদ এর ভয় থেকে বিয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে না।

নতুন যুগে দায়িত্ব নেয়ার ভয়ে পুরুষরা যদি বিয়েতে আগ্রহ না দেখায় তবে কেমন করে বিয়ে হবে।

একটা মেয়ে একটা ছেলের মতোই নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করে। কিন্তু সেই ক্যারিয়ার গড়তে বাধা সৃষ্টি হয় সন্তান লালন পালন করতে গিয়ে। ছেলেটা ঠিকই প্রমোশন পেতে পেতে উপরে উঠতে থাকে । আর মেয়েেটা পারে না।

তাদের মতে সন্তান নেয়া এবং পরিবার গঠন করা একটা “Laif Long responsibility” , এটা একটা খেলা নয়,

এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার।” একবার যখন কেউ সন্তান জন্ম দিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে আসলো কিন্তু ভালো পরিবেশ দিতে পারল না তা হলে কেন তাদেরকে দুনিয়াতে নিয়ে এসে কষ্ট দেওয়া?

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসার ব্যবস্থা , শিক্ষার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা নাই অথচ তাদেরকে পৃথিবীতে নিয়ে এসে তাদেরকে কষ্টে ফেলা আর কষ্ট চেয়ে চেয়ে দ্যাখা এটা কি কোন দায়িত্ব বান বাবা/মার কর্তব্য হতে পারে?

অভিভাবকরা মনে করে বিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। নিজেদের মৃত্যুর পর সেই তাকে নিরাপত্তা দিবে। কিন্তু পরবর্তী জেনারেশনের মতে, একটা দেশ যদি মেয়েদের নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে পারে তা হলে পুরুষের কাছ থেকে আসা বিপদগুলো তো আর আসবে না।

বংশ রক্ষা করার জন্য সন্তান দরকার, এই নীতি নেক্সট জেনারেশনের কাছে আর গ্রহণ যোগ্য নয়। তাদের মতে পৃথিবীতে যতো মানুষ দরকার তার চেয়ে অনেক মানুষ হয়ে গেছে, এখন আমাদেরকে ক্ষান্ত দাও।

তাদের যুক্তি পরিবেশ রক্ষা করা এবং Naturalist Devid Attenborough এর উক্তি ফলো করা । আর সেই বিখ্যাত উক্তি হলো “ আমার জন্মের সময় ২ বিলিয়ন মানুষ ছিল পৃথিবীতে, এখন ওভার ৭ বিলিয়ন। ওভার পপুলেসান পরিবেশ রক্ষার জন্য হুমকি স্বরূপ । যখন নারী জাতি শিক্ষিত হবে, নিজের বডিকে কন্ট্রোল করতে সক্ষম হবে, নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছা মতো গোছাতে শিখবে, তখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা পাবে “ ।

তাদের মতে, বিয়ে করা বা না করা যার যার বাক্তিগত সিধ্বান্ত এবং এই সিদ্ধান্তকে সন্মান দেয়া শিখতে হবে।

নেক্সট জেনারেশনের কাছে বিয়ে একটা “ পুরানো পদ্ধতি” ( Back Dated )। তারা বলে তোমাদের ব্যাকগ্রাউনড আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড নয়। তোমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা নাও হতে পারে।

নারী বান্ধব দেশগুলোতে মেয়েরা শতভাগ নিরাপদ জীবনেই থকতে পারে। অফিস আদালতে, ট্রেনে, বাসে, রাস্তা-ঘাটে মেয়েরা নিরাপদেই থাকে ।

নতুন জেনারেশনের দর্শন “ নারী মানেই যে সন্তান ধারণ করতে হবে এই ধারনা ঠিক নয়। বিয়েটাও তাই। পাশে একটা পুরুষ নিয়ে জীবনের সংজ্ঞা তৈরী করতেই হবে এর মানে নেই” ।

একটা মেয়ের জীবন ভালোভাবে চলতে থাকে বিয়ের আগ পর্যন্ত। দেখা যায় যত অপমান, আবমাননা আসে বিয়ের পর ।

নিজের কোনো মতামত থাকে না, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয় না, যৌতুকের বলি হওয়া ,মাথা ন্যাড়া করে দেয়া, গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা সব আরম্ভ হয় বিয়ের পর। বিয়ে করার পরিমাণ যদি এই হয়, কোন শিক্ষিত, নিজের পায়ে দাঁড়ান মেয়ে এই দিকে অগ্রসর হতে সাহস পাবে ? সমস্যাগুলো এই খানে।

বিয়ে হওয়া মানে একটা সঙ্গী পাওয়া অনেকে বলে থাকে। ভালো সঙ্গী হওয়ার গ্যারান্টি কে দিবে?

ইতিহাস থেকে দেখা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মেয়েরা সমাজে সাফার করে আসছে। মধ্য যুগে গ্রিস, ইটালি, চিন , খোদ এই ওয়েস্টার্ন ইউরোপে মেয়েরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

তাদেরকে সন্তান জন্ম দানের ভূমিকায় শুধু থাকতে হতো। অনেক যুদ্ধ করে একটু একটু করে আজ মেয়েরা বর্তমান অবস্থায় আসতে পেরেছে।

কিন্তু এখনোও ভুক্তভোগী দক্ষিণ এশিয়া ,মিডল ইষ্ট ,মধ্য এশিয়া সাউথ আমেরিকা এবং আফ্রিকার মেয়েরা।

নারীরা যত নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হবে, দেশগুলো নারী বান্ধব আইন কানুন শক্তভাবে প্রচলিত হবে তখন বিয়ে করবে কি করবে না এই সিদ্ধান্ত তারা নিজেরার্ই নিতে পারবে।

দেখা গেছে যে সব দেশে নারী বান্ধব পরিবেশ আছে, কঠোর আইন আছে এবং আইনের প্রয়োগ আছে সে সব দেশে বিবাহ জনিত ব্যাপার যেমন, ডিভোর্স , সিঙ্গেল থাকা এইসব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। জীবন যে সংসার নিরাপদ নয় সেখানে সমাজে দেখানোর জন্য বিবাহিত জীবন চালানো, সেখানকার সমাজ এনকারেজ করে না। তাছাড়া জোর করে কিছু করা যায় না। “ Force marriage” অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে জোরাজুরি করা আইন বিরুদ্ধ । নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবন চালানো থেকেই যত মানসিক অসুখের সৃষ্টি। মেয়েদের আত্মহত্যা , depression এবং Anxiety এর পেছনে আছে সংসারের যাঁতাকলে দুর্বিষহ জীবনের কষ্ট ।

উন্নত দেশগুলোতে নারী এবং পুরুষের মধ্যে Equal Right এবং Equal Oportunity মেনে চলা হয়। পরিবারে, স্কুলে চাকুরী পাওয়ার ক্ষেত্রে সব জায়গাতে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো একটা সাধারণ ব্যাপার। পক্ষপাতিত্ব নাই কোথাও। এগুলোর চর্চা একটা মেয়েকে কনফিডেন্স দেয় , সুন্দরভাবে জীবন রচনা করতে সাহস দেয়।

অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলোতে বিয়েটাকে মনে করা হয় অবশ্য কর্তব্য একটা প্রচলিত প্রথা। যা থেকে বেরুবার পথ নাই। বিয়েটা দিয়ে বাবা/মা মনে করে তাদের কর্তব্য শেষ। তারপর তার কি হলো, কীভাবে জীবন যাচ্ছে সেদিকে খুব কমই নজর দেয়া হয়। মারামারিপূর্ণ সংসার হলেও তা মেনে নিতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় সব অত্যাচার মেনে নেয়াই মেয়েদের কাজ। মানলে সে ভালো না মানলে সে সংসার করতে জানে না।

তাছাড়া একটা মানুষ জীবনে কি চায় না চায় তা বুঝে উঠার আগেই তাকে ঠেলে দেয়া হয় সংসারের গ্যাঁড়া কলে ।

পরবর্তী জেনারেশানের যুক্তি , এগুলোে হলো মধ্য যুগিয়ো বর্বরতা । এ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেতে চায়। সব কিছু একটা শেষ সীমা আছে। মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে নিঃশেষিত করা হয়।

বংশ ধরে রাখা, সম্পত্তির উত্তরাধিকারি করা, বুড়ো বয়সে দেখভাল, অবসর জীবনে সন্তানের অর্থে চলা এগুলো ওয়েলফেয়ার দেশগুলোতে দরকার পড়ে না।

বাবা/মার সম্পত্তির আশায় তারা বসে থাকে না।সম্পত্তি সন্তানদের জন্য রেখে যেতে হবে এই নীতির প্রচলনও তেমন নাই এখানে। সবার জন্য পেনশন আছে। মানসম্পন্ন নার্সিং হোম আছে ।

অতি গরীব শ্রেণির সম্পত্তিই নাই তাই ক সে রেখে যাবে?

বিবাহ এবং পরিবার গঠন এর ইতিহাস থেকে জানা যায় বিভিন্ন সময়ের পারিপার্শিক অবস্থার উপরে এর পরিবর্তন নির্ভর করে। আদিকালে বিবাহ প্রথা ছিল না। তারপর এলো দলগত বিবাহ। সন্তানাদি দলগতভাবে বড়ো করা হতো।

যখন কৃষি যুগ আরম্ভ হলো ,মানুষ এক জায়গাতে স্থায়ী হলো, দরকার পড়ল জমিজমা। এই জমি মৃত্যুর পর শুধু মাত্র নিজস্ব সন্তানকে দেয়ার জন্য কোনগুলো নিজস্ব সন্তান তা জানার দরকার পড়ল ।সন্তান চিহ্নিত করার জন্য চিহ্নিত মা থাকা প্রয়োজন পড়ল । এই প্রয়োজনেই বিবাহের মাধ্যমে নারী পুরুষ সংসার আরম্ভ করল।

তাছাড়া কৃষি কাজে সাহায্যের জন্য প্রচুর লোকবলের দরকার পড়ত এই জন্য নিজেদের সন্তান লাগত এই লেবার ফর্স এ যোগদানের জন্য। বেশি সন্তান মানেই বেশি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ।

এই ভাবেই বিভিন্ন যুগে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সগোত্র বিবাহ, আসবর্ন বিবাহ, সম্মতি সাপেক্ষে বিবাহ, বলপ্রয়োগ বিবাহ, এক বিবাহ এবং বহু বিবাহ, বহু পতিত্ব বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, একান্নবর্তি পরিবার, নিউক্লিয়ার পরিবার, সিঙ্গেল মাদার পরিবার, বিবাহ করা না করাকে নিজস্ব ইচ্ছার মধ্যে ফেলা এবং এখন বিবাহ নামক ব্যবস্থাকে পরিহার করা শুরু হতে যাচ্ছে।

অনেক বিবাহ আবার কিছু বছর থাকার পর বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়ে দুজনের মধ্যে সন্তান দেখাশুনা এবং বন্ধুত্ব চালিয়ে যাওয়ার নিয়ম চালু হচ্ছে।

এটাও হয়তো একবিংশ শতাব্বদির নতুন কোন পথ দেখাবে সমাজকে ।

বিয়ের প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার একটা মূল অর্থনৈতিক কারণ হলো মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়া। এর কারণ সভ্যতার আদিম স্তরে নারী ছিল অসহায়। তাকে পুরপুরি ভাবে পুরুষের উপরে নির্ভর করতে হতো। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা তাকে নিজস্ব উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দিয়েছে শক্তিশালী নিরাপত্তার বেষ্টনী।

এই আর্থিক কারণ ছাড়াও নারী এবং পুরুষ উভয়ই বিয়ে করতে কম আগ্রহী । সমাজ বিজ্ঞানী Edward Westmark এর মতে “ সাধারণ ভাবে শিল্প – সংস্কৃতির প্রসার, বাণিজ্যের প্রসার, শিক্ষাদীক্ষা এবং সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে নারী এবং পুরুষের জীবন সম্পর্কে ধারনায় বদলে গেছে। তাদের চাহিদা বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিত্যনতুন আরাম দায়ক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির ফলে তাদের বিবাহিত জীবনে পারস্পরিক আদান প্রদানও কমে গেছে। আগের মতো ঘরের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ জীবন যে জীবন নয় সেটা তারা বুঝে গেছে। স্বাধীন জীবনে যে সুখ সুবিধা তা যে বিবাহিত জীবনে পাওয়া যায় না সেটার উপলব্ধি ঘটেছে” ।

Tourism Industry এর সহজলভ্যতা , দ্রুত বিস্তার এর ব্যবস্থা যখন বৃদ্ধি হলো এবং এর আনন্দদায়ক ফলাফল যখন মানুষ বুঝতে শিখল, মানুষকে আর আবদ্ধ রাখা সম্ভব হলো না।

এই ভাবেই হয়তো সমাজের পরিবর্তন হয়। ভবিষ্যতই বলে দিবে কী হবে। মানুষ যা করে সেটাই সমাজ। মানুষ সমাজকে বদলায়, সমাজ মানুষকে বদলায় না। সমাজ তার নিজের গতিতেই চলে।