চৈত্রসংক্রান্তি : বাঙালির চিরন্তন এক উৎসব/আইভি সাহা

চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে চৈত্রসংক্রান্তি বলে মানা হয়। চৈত্রসংক্রান্তিতে দারুণ আয়োজন ও উৎসব থাকে বাঙালীদের ঘরে ঘরে। তবে একেক অঞ্চলের একেক রকম নিয়ম লক্ষ করা যায়। স্থানভেদে নিয়মের ভিন্নতা রয়েছে।

আমার ছোটবেলাকার এই চৈত্র সংক্রান্তির দিনগুলো খুব মনে পড়ে। আমাদের পারিবারিকভাবে নানাবিধ নিয়মকানুন ছিল এই বিশেষ পার্বণ দিনকে ঘিরে।

পূজা অর্চনা, প্রার্থনা, গীতা পাঠ দিয়ে এই দিনটির প্রথম প্রহর শুরু করা হতো, কারণ যায় দিন ভালোই,অনাগত দিনগুলো আরও মঙ্গলময় হোক আর রাত পোহালেই একটা নতুন বর্ষ আরম্ভের সূচনা লগ্ন তাই নতুন বছরের শুভারম্ভ হোক শুভ সূচনায়। যাতে আগামী দিনগুলো আরও শুভ হয় সকলের জন্য।
মঙ্গলময় হোক নতুন বছরের প্রতিটি দিন ক্ষণ, পুরাতন জড়াজীর্ণ সব ধুয়ে মুছে যাক।
মূলত নতুন বছরকে বরণ করে নিতেই চৈত্রের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তিকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করার রেওয়াজ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

ধর্মীয় আচারের পাশাপাশি বিভিন্নরকম খাবারের বিশেষ আয়োজন থাকে এই বিশেষ দিনে। খইয়ের ছাতু ( খই গুড়ো করা) মুড়ির ছাতু(গুরো করা মুড়ি) বানানো হতো। এই গুরো বা ছাতু দিয়ে,এরমধ্যে নারিকেল কুচি,চিনি,দুধের ক্ষীর,ঘি মিশিয়ে নানান ধরণের মোয়া তৈরী করে আগেই রাখা হতো। এ নিয়ম এখনও প্রচলিত আছে ঘরে ঘরে।

খই, মুড়ির ছাতু বানিয়ে ছোট মাটির হাড়িতে খুব যত্ন করে মুখ বেঁধে ঢেকে রাখা হতো এই চৈত্র সংক্রান্তি দিনের পরবের জন্য।
ধর্মীয় অনুভূতিতে একে বলা হয় ‘বরণ’ ভরে রাখা’

এই সংক্রান্তি দিনে হাড়ির বরণ খুলে কিছুটা পূজাতে নিবেদন করে তারপর খাওয়া হতো।
ঘরে মাটির হাড়িতে দই বসিয়ে দই বানানো হতো। টক, মিষ্টি দুই রকম দই বানানো হতো।
আরও থাকতো তরল দুধকে ঘন করে ক্ষীর তৈরী করে রাখা এটা বিশেষভাবে তৈরি করতেই হবে এমন নিয়ম ছিলো।

ঘরে বানানো হতো হরেকরকম নারু, ছানার সন্দেশ, লাড্ডু, মিষ্টি এসবতো প্রচলন ছিলোই।
আর চিড়া ভিজিয়ে নিয়ে, খই ও মুড়ির ছাতুর সঙ্গে দই,কলা,ক্ষীর,মিষ্টি এগুলো একসঙ্গে মেখে খাবার একটা রেওয়াজ ছিলো এবং এখনও আছে সংক্রান্তির দিন সকাল বেলা।
এইরকম নানান আইটেম একসঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে, মেখে নিয়ে খাবারের মজাই আলাদা।
এমন স্বাদ মনে হতো এ যেনো অমৃত খাচ্ছি সবাই মিলে
এখনও এমন করে সবাই মিলে একসঙ্গে খাবার খাওয়া রেওয়াজ চলছে আমাদের পরিবারে।

এসব আয়োজনের সঙ্গে আরও একটা বিশেষ খাবার এই দিনকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে। সবরকম সবজির সমাহারে পঞ্চব্যঞ্জন রান্নার রেওয়াজ প্রায় এখনও সব অঞ্চলেই রয়েছে কম বেশি।
বিশেষ কিছু সবজি থাকতেই হবে এরপর যার যে রকম ইচ্ছে নানান ধরণের সবজি মিশিয়ে নিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়। এর মধ্যে কাঁচা কাঁঠালের তরকারিও উল্লেখযোগ্য খাবার হিসেবে গণ্য হয়।
অঞ্চল ভেদে নামকরণও ভিন্নতা রয়েছে এই খাবারের।

এই চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকেই মেলা বসে অনেক অঞ্চলে, শহরে কিম্বা গ্রামের হাট বাজারে এসময় বৈশাখী মেলা বসে।
আমাদের এলাকায় বরিশালের গৌরনদী বন্দরে বহু বছর ধরে এমন বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। কেউ কেউ এই মেলাকে সংক্রান্তির মেলাও বলে থাকে।
এই মেলায় সাধারণত বাঁশ,বেত,কাঠ,মাটির সামগ্রী বিক্রি করা হতো অনান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে।
তবে কাঁচের চুড়ি ও নানা রঙের ফিতা বিক্রি হতো।

এর পাশাপাশি মেলায় মিষ্টি খাবারের আইটেমগুলো ছিলো বেশ, দোকানীরা মিষ্টি খাবারের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বসতো মেলায়।
তবে এসব মেলার মুচমুচে জিলিপি ভাজা খেতে দারুণ মজাদার ছিল।

খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে মেলায় যেতাম মনে পড়ে। অনেক ধরণের বাঁশির আওয়াজ শুনতে পেতাম।
বেশ ভিড় ঠেলে কষ্ট করে মেলায় ঢুকতে হতো।
রাধাচক্করে বা নাগরদোলায় চরে অনেক বাচ্চাদের মজা নিতে দেখতাম দূর থেকে চেয়ে থেকে।
কিন্তু আমার এসব চড়ার সাহস কখনও ছিলো না।
বাবার হাত ধরে পছন্দের খেলনাগুলো কিনতাম আর সেগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে আসার আনন্দ ছিলো দারুণ অনুভূতির।

একটু বুঝতে যখন শিখেছি তখন আর যেতাম না ভিড়ের মধ্যে গরমে। মা যেতে দিতেন না।
তবে মেলা থেকে পছন্দের জিনিস আনা চাই।
সে সময় সবচেয়ে বেশি খুশি হোতাম মাটির তৈরি বাহারি রঙের খেলনা হাড়িপাতিল পেয়ে।
এগুলো কেনার দায়িত্ব ছিলো আমাদের বাড়ির ছোট কাকুর। অনেকগুলো সেট কেনা হতো ছোটদের সবার জন্য। মানুষ দিয়ে মাথায় বয়ে বাঁশের ঝাকাতে করে সেগুলো নিয়ে আসতো বাড়িতে।
তবে কাকুর বাড়িতে ফেরা অবধি অপেক্ষা করতে হতো তিনি এসে নিজের হাতে বুঝিয়ে দিতেন।

কী ছিল না এই খেলার সামগ্রীতে? চুলা,কলসি, কড়াই, হাড়ি,থালা গ্লাস,এমন কী মুড়ি ভাজার মতো জিনিসপত্র।
সাথে একটা মাটির ব্যংক কিনে দেওয়া হতো এই মেলা থেকে যাতে পয়সা জমিয়ে রাখা হতো। আর সেই ব্যংক ভেঙে পয়সা বের করার জন্য অস্থির হোতাম।
চমৎকার এমন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আজ আবার ফিরে গেলাম সেই সোনালী দিনের হারানো শৈশবের দিনগুলোতে।

ঠিক এর পরের দিন পহেলা বৈশাখ তাই ঘরে ঘরে প্রস্তুতি ও বর্ণিল আয়োজন থাকে নতুন বছরকে বরণ করে নেবার জন্য। ধর্মীয় নানাবিধ নিয়মকানুন আর বাঙালীদের নিজস্ব সংস্কৃতির মেলবন্ধনে বর্ষররণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় দেশের সব অঞ্চলে।

‘মুছে যাক পুরনো জরাজীর্ণ গ্লানি যত কষ্ট শোক তাপ
মানুষ থাকুক সুখে -শান্তিতে খেয়ে দুধ ভাত’

শুভ হোক নতুন বছর এই প্রত্যাশা রইল…

—আইভি সাহা

১৩/ ৪/ ২০২৪