আহারে জীবন/ রানা ইবনে আজাদ

আহারে জীবন (ধারাবাহিক উপন্যাস) পর্ব- ১



পৃথিবীতে কোনোকিছু ফেলে আসা বা ছেড়ে আসা বড্ড কঠিন কাজ । নিজের চেনা পরিবেশ নিজের চেনা ছায়া, গন্ধ, ছোঁয়া, দুম করে পেছনে ফেলে চলে যাওয়াটা বড্ড কঠিন একটা কাজ। বুকের ভেতর যে প্রচন্ড রক্ত ক্ষরণ হয় সেই ক্ষরণ যদি দৃশ্যমান হতো তাহলে ছেড়ে চলে যাওয়ার বদলে আই সি ইউতে ভর্তি হতে হতো ।

বাবা সরকারী চাকুরে । এই আজ এখানে তো কাল ওখানে । তখনকার সময় যে বদলি কাটিয়ে নেয়া যেতো না তেমন কিন্তু না। কিন্তু বাবাকে কখনই দেখতমা না এই সব ব্যাপারে কথা বলতে । আশে পাশের অনেককেই দেখেছি বছরের পর বছর তারা একই এলাকায় থেকে হাতে পায়ে গাছ পাথর জমিয়ে ফেলেছেন এমন কি ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নাতি পুতির বিয়ের জোর তদবির চালাচ্ছেন । সেইক্ষেত্রে আমাদের এক সেট ব্যাগ গোছানোই থাকত বাবা কোন দিন না এসে বলেন একটু পরে ট্রাক আসবে মালপত্র রেডি করে ফেলো। আমরাও মুখ কালো করে যার যার বিছানাপত্র গোছাতে লেগে যেতাম ।

ময়মানসিংহ থেকে নওগাঁ বদলি হয়ে যাচ্ছি । বড়দা কিছুক্ষণ পরপর চোখ ডলছে সেই সাথে তার তল্পিতল্পা গোছাচ্ছে। চোখ ডলার কারন শিউলি আপা। আমরা ময়মনসিংহ এসেছি দুই বছর হলো। এর মধ্যেই বড়দার সাথে শিউলি আপার বেশ ভালই দহরম হয়ে গেছে । ছোটো হিসাবে আমারো একটা সুবিধা ছিল । শিউলি আপার বাসার মুলাটা, তালটা, কলাটার ভাগ পেতাম সেই সাথে চকলেট বিনিময়ে তাদের গোপন পত্রের চালান আমার হাতেই হতো । আমি নিষ্ঠার সাথে আমার দায়িত্ব পালন করতাম অবশ্যই বিনিময় প্রথায় বিশ্বাস রেখে । শিউলি আপাকে দেখছি বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে । আমাকে দুই তিন বার ইশারাও করেছে , পাত্তা দেই নাই । ছোট হলেও বুঝে গেছি আমরা চলে যাচ্ছি মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই । আমি অবশ্য মনে মনে খুশি পাশের দোকান থেকে বাকিতে চানাচুর আর বিস্কুট এনে খেয়েছিলাম কোন রকমে যদি যেতে পারি তাহলে আর দিতে হবে না কারন বাকি শোধ করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও উপায় নাই , মা জানতে পারলে ঝাঁটা দিয়ে প্রথমে ব্রাশ করবে পরে কার্পেট ধোলাই করবে। টাকার পরিমান কম না প্রায় দশ টাকা । অবশ্য দোকাদার ছেলেটা ভীষণ ত্যাদর! দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার মনে করিয়ে দেয় বাকীর কথা ।

মা নেয়ে ঘেমে একাকার । ফর্শা মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে । কোমরে আঁচল গুঁজে খাটের নিচ থকে হাজারো ধুলার মাঝখান থেকে জোরাতালি দেয়া সুটকেস টা টেনে বাহির করতেই হাঁপিয়ে গেছে। আমাকে আড় চোখে একবার দেখে কিছু না বলে অন্যকাজে ব্যাস্ত হয়ে গেল । মায়ের জন্য আমার খুব দুঃখ হয় শুনেছি মা খুব ধনী বংশের মেয়ে ছিল । বাবা টিউশানি পড়াতো মাকে , একদিন সন্ধ্যায় বাবা মায়ের হাত ধরে নাকি কেঁদে বলল আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। এতেই মা গলে গেলেন, তার ধারনা হলো বাবা এখনি গলায় ফাঁসি দিয়ে মরে যাবে, ওই দিন রাতেই মা বাবার হাত ধরে পালিয়ে গেল। তার মায়ের মানে আমার নানীর বিশ ভড়ি স্বর্ণ আর নানার ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে । আমার মা কি বোকা! কেউ বলল তাকে ছাড়া বাঁচবে না ওমনি সে গলে গেল । আজকাল কেউ এইসব বিশ্বাস করে নাকি! আমার নানার দিকের কেউই আমাদের দেখতে পারেন না । মামারা আমাদের দূর দূর করেন । নানী তার বিশ ভড়ি স্বর্ণের দুঃখে নাকি এখনো তার মেয়ের মুখ দেখতে চান না।কেবল নানা মাঝে মধ্যে এসে আমাদের সাথে দুই তিন দিন থাকেন। সেই সময় অনেক মজা হয় । আমাদের বাসায় ঈদের আনন্দ লেগে থাকে । পেটপুরে ওই তিনদিন আমরা খাই । বাবাকে দেখেছি নানা যতোদিন থাকেন ততোদিন একদম বিষহীন সাপের মতো ঘরের কোনায় কোনায় ঘুরে বেড়ান মাঝে মাঝে ফনা তোলেন ঠিকই কিন্তু নানাকে দেখে তার ফনা নামিয়ে ঘরের কোনে এক গর্তে ঢুকে যান। আমি অবশ্য একটা বিষয় ভেবে পাই না আমরা এতো বদলি হই নানা কি করে জানি ঠিকই আমাদের খোঁজ পেয়ে যান । হঠাৎ একদিন এসে আমাকে চমকে দেন । নানা আমাকে কালুয়া বলে ডাকে। আমি কালো তো তাই ।

শিউলি আপা জানালায় দাঁড়িয়ে চোখ বড়বড় করে আমাদের গোছগাছ দেখছেন । বড়দা একবার করে জানালায় যাচ্ছে আর চোখ মুছেতে মুছতে ফিরে এসে নিজের ভাঙ্গা ট্রাংক ঠিকঠাক করছে লজ্জিত ভঙ্গিতে । শিউলি আপা খুব উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থেকে চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করছে তোমার কি একটাই ট্রাংক? বড়দা মাথা নিচু করে কেবল হুম বললেন । শিউলি আপা জানালা থেকে সরে গেলেন আমাকে আড়াল করে কিন্তু আমি যা দেখার তা ঠিকই দেখে নিলাম। শিউলি আপা মুখ বাকিয়ে ফিরে গেলেন । আমরা আসলে অনেক গরীব । বাবা যে বেতন পান তাতে আমাদের একদম চলে না। সরকারী বাসাও আমরা পাই না। ট্রাকে সব তোলার পরেও আর্ধেকেরও বেশি খালি পরে ছিল। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড় । কি দরকার ছিল এত্ত বড় হাতির মতো একটা ট্রাক আনা । আমাদের মালপত্র নাই বললেই চলে, আমরা মাটিতেই শুই, কেবল নানা এলে একটা চারপায়া, যার দড়ি গুলো প্রায় ছেঁড়া, ঘড়ের এক কোনে পাতা হয় কিন্তু নানা তাতে শোয় না বলে মাটিতেই নাকি অনেক মজা ঘুমাতে, আমি অবশ্য কোন মজাই পাই না, নান ঘুমিয়ে গেলে আমি চুপিচুপি গিয়ে সেই চারপায়ায় শুতে যেয়ে দেখি বড়দা ঠ্যং উচু করে শুয়ে আছে।

থাকার মতো একটা বড় আলনা আছে যা গতো বছর কোরাবনীর ঈদে বাবা মা কে সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিল। আমরা কোরবানী দিতে পারি না , গরুর মাংসের অনেক দাম চল্লিশ টাকা কেজি, বাবা সর্বসাকুল্লে বেতন পান তিনশো টাকা । প্রথম যেদিন আলনাটা আমাদের বাসায় এলো আমরা আমাদের সকল আকর্ষণ ওই আলনায় অনুভব করতে লাগলাম। একটু পরপর দেখে আসতাম আলনা জায়গা মতো আছে কি নাই । বড়দা বলেই ফেলল তার এই আলনার এক পাশে কাপড় রাখার অধিকার চাই । আমি ও ভাবছিলাম আমার হাফ প্যান্ট দুইটা রাখা যায় কি না কিন্তু দাদার ওমন চোটপাট দেখে আমার আর বলার ইচ্ছা হয় নাই । ঘরের মাঝখানে লম্বা করে টানানো রশিতে আমাদের কাপড় ঝুলে থাকত । আমরা যে যার খুশি মতো যখন ইচ্ছা সেই রশি থেকে কাপড় টেনে নিতাম। আলনাটা আসার পর থেকে আমাদের বাসায় একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া পেলাম । মাঝে মাঝে ভেজা কাপড় দিয়ে আলনা টা মুছে দিতাম, যাতে ধূলা না পরে । আসলে মোছার উসিলা ছুঁয়ে দেখতাম। কি যে ভালো লাগত।

আলনাটা ট্রাকের উপর টেনেটুনে তোলা হলো। আমাদের সবার কাপড় ওখানেই বিভিন্ন ভাবে ঝুলে ছিল । আমার তো ট্রাংক নাই ট্রাংক কেবল বাবার ছিল আর দাদা কোথা থেকে যেন একটা ভাংগা ট্রাংক জোগাড় করে নিয়েছিল। আমার তালি দেয়া হাফপ্যান্টা ঠিকই সবার উপরে দেখা যাচ্ছে। আম্মার আক্কেল দেখো, কেউ কালো প্যান্টে লাল কাপড় দিয়ে তালি দেয়? সুন্দর মতো সেই লাল তালি ওয়ালা প্যান্ট উঁকিঝুঁকি মারছে। বড়দা কিছুদিন আগে আমাদের বাসার পেছনের পচা ডোবা থেকে একটা হেড লাইট কুড়িয়ে পেয়েছিল। আমরা বাসার সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে ভাবতে বসলাম ওটা কিসের হেড লাইট । দাদা বলল আমি নিশ্চিত ওটা মটর সাইকেলের হেড লাইট এবং বাঁকি অংশ ওই ডোবায় আছে এর পর থেকে সে প্রায় ডোবার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো । সেই হেড লাইটাও ট্রাকের এক কোনে আরাম করে ঝিমাচ্ছে।

কবি আঞ্জুমান আরা খান

সকল পোস্ট : আঞ্জুমান আরা খান