শাহীন সুলতানা : রোমান্টিক পদাবলীর ধ্রুপদী ভাস্কর/ হুমায়ুন কবীর

ছোট্টকাঠামোর অনন্য ভালোবাসার উচ্চারণ। নিজের আনন্দকে সকলের মাঝে সঞ্চালন ।মুহূর্তে অভিনন্দন আর মুগ্ধতায় কমেন্ট বক্স উপচে পড়া।ফেসবুকের স্ক্রিনে করস্পর্শ করতে করতে পেলাম এক কবির সন্ধ্যান— নাম শাহীন সুলতানা।পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক, জন্ম সাতক্ষীরার এক পাখিডাকা, ছায়াঢাকা গ্রামে । তার লেখায় আগ্রহটা জন্মালো তার পেলব স্বরের নমিত প্রকাশ দেখে। মনে হলো এ যেন কবির হৃদয়ের অনুভূতির শৈল্পিক বুনন।সত্যি বলতে কি, তার শুদ্ধস্বরে শিল্পস্তুতি লক্ষ করার মতো। তার এই পদগুলোর পোস্ট মর্টেম করলে মনে হয় প্রেমের এই উচ্চারণগুলো স্নিগ্ধ এক মাধুর্যলোকে উত্তীর্ণ।

“আমি রোজ রোজ তোমাকে অসংখ্যবার
ভালোবাসতে চাই —
অসংখ্যভাবে, অসংখ্য
বাহানায়”—-

আয়তনে হ্রস্ব, ব্যাখ্যায় দীর্ঘ এমন পঙতিগুলো চলমান যুগে ব্যস্ততম মানুষের উপযোগী। হাতে সময় নেই, চটজলদি পড়ে নেওয়া চলে। কিন্তু চলতে চলতে অথবা অবসরে অনুভূতিটা মনে নাড়া দেয়।তার এমন লেখার বৈশিষ্ট হচ্ছে, তা গল্প অথবা কাহিনি কাব্যের মতো অন্যের কাছে বর্ণনা করা যায় না— শুধুই আপন মনে অনুভূত হয়। এর চিন্তার নির্যাসকে গ্রহন করা যায়, অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায় না—- অথবা সঞ্চারিত করা রীতিমতো কঠিন। এই যেমন—-সহস্র-অযুত-লক্ষ মানুষের ভীড়ে
শুধু তোমাকেই খুঁজে ফেরে কেন
এই মন!
তবে কি তুমিই সেই নক্ষত্রবীথি
অনেক সাধনা করা পাখি
হীরামন ?
এই অনুভব নৈর্ব্যক্তিক না, নিতান্তই ব্যক্তিগত। এই অনুভূতি সামষ্টিক না,একেবারেই আত্মগত।মজার ব্যাপার হচ্ছে এই আত্মগত বিষয়টা সাময়িক না,চিরকালের। আর চিরকালের বলেই তা সাহিত্য পদবাচ্য।

শাহীনের পঙতিগুলো প্রেমের, তবে চটুল প্রেমের বাণী সেগুলো মোটেও না। প্রেমের শুদ্ধতাকে এক রাশ আবেগে জড়ায়ে অঞ্জলী ভরে দাঁড়ান তিনি সমুদ্রের ওপারে; আর এপারের মানুষকে বলে,লহ অঞ্জলি মোর…। কাকে দেন এইসব ভালোবাসা? সে জানে না।যে নিবে এই ভালোবাসা সেও জানে না—- এমনই দূর ভূবণে তার সাহিত্য – আবাস। দূর থেকে একটা পবিত্র অনুভূতি সঞ্চারিত করে দেন। কোন ক্লেদ তাকে স্পর্শ করে না,কোন মলিনতা তাকে ক্লান্ত করে না। মানুষের প্রেম নামক এই অনুভূতির চর্চাটা তিনি করতে চান, যাতে করে মানুষের হৃদয়বৃত্তি প্রস্ফুটিত হয় শতদলে। বিদ্বেষ না, হিংসা না, হোক মানবিক বোধের অনুশীলন এই তার কাম্য।এক পঙতির রোমান্টিক পদে কখনো তিনি নিয়ে আসেন ছন্দের অন্ত্যমিল,কখনো গদ্যের মুন্সিয়ানায় দেন কাব্যিক প্রলেপ।ভালোবাসা অন্তপ্রাণা এই কবি বলেন :
আমার কাছে তুমি মানেই
ছুঁতে না পারা অসীম আকাশ
আমার কাছে তুমি মানেই
চোখ নির্ঘুম আষাঢ়ের মাস।

এই লেখনি স্টাইলে কবির একটা স্বাতন্ত্র দেখি।হয়তো কবিতা, হয়তো কবিতা না— তবু বিষ্ময় জাগে, মনে হয় কবিতার মতো । আধুনিক গদ্য কবিতার জনক বোদলেয়ার বলতেন,কবিতায় সব বলতে নেই — অনেকখানিই করতে হয় গোপন। পাঠককে পরিশ্রম করতে দিতে হয় ; পাঠক পরিশ্রমের মধ্যে কবিতার স্বাদ পায়। চিত্রকল্প নির্মাণ করেন কবি, রূপক ব্যবহার করেন কবি— এগুলো পাঠককে বুঝতে হয় চিন্তা করে —- আর এখানেই পাঠকের আনন্দ। চিত্রকল্পই কবিত্ব —- এমনটিই তো কবিদের বলতে শুনি । শাহীন সুলতানার চিত্রকল্পগুলো মনে ধরে —–
তুমি পদ্ম- কুসুমের মতো কোমল
তুমি শরৎ শিশিরের মতো ঝলমল
চাঁদের জোছনার মতো তুমি স্নিগ্ধ —- —–
তোমাকে অবলীলায় ভালোবাসা যায়।

তিনি সলাজ বধূটির মতো না।দ্বিধা- জড়িত না তার কণ্ঠ বরং তার কণ্ঠ মুক্ত – স্বাধীন- বাধা- বন্ধনহীন। যুগ এগিয়ে ; তবু মনে হয় কবি এগিয়ে যুগের চেয়ে বেশি।হৃদয়ের স্বতোৎসারিত আবেগে উদ্বেলিত তার এই উচ্চারণই তার প্রমাণ—-
বিশ্বাস করো
তোমাকে নিয়ে আমার বিষ্ময়ের অন্ত নেই
মানুষের চোখ আর কলম এতো সুন্দর হয় কী করে?

স্বীয় প্রেমজ ভাবনার অকুন্ঠ প্রকাশ সাহসী মানুষের কাজ।পাছে লোকে কিছু বলে— এই এক ভয় ।সর্বকালের প্রতিভাবান মানুষ এই ভয়কে আমলে নেয় না।বিপদটা সাধারণ মানুষের — পর মানুষের নিন্দা,আপন মানুষের সন্দিগ্ধ চিত্ত—এ দুটোকেই মোকাবেলা করতে হয়।
পঙতি নির্মাণে তার অকুণ্ঠ প্রকাশ —তুমি সুন্দর
তোমার চোখ বলছে তুমি কবি
তোমার হাসি বলছে তুমি শিল্পী
তোমার মুখশ্রী বলছে তুমি প্রেমিক —-
তোমাকে ভালো না বেসে থাকা যায়?

একবার মনে হয় আমরা এক অগ্রসর সময়ে বাস করছি।পরক্ষণেই ভাবি সময় এগিয়ে,তবু্ও রক্ষণশীলতা গ্রাস যে একেবারেই করে না তা তো নয়। এই আধা- প্রগতি – আধা রক্ষণশীল সমাজে শাহীনের এইসব অকপট উচ্চারণ যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত হতেই পারে। তবে ভেবে দেখা দরকার, শুধু রক্ত মাংসের নারী পুরুষের বিরহ- মিলন না, প্রেমের রাজ্য সুবিস্তৃত বিধাতা এবং বিধাতার সৃষ্টিরাজি বৃক্ষ – প্রাণী – জড়বস্তু সর্বত্র। রবীন্দ্রনাথ একটা কুকুরকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন।প্রখ্যাত সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রেমের কবিতা সংকলনে কবিতাটির স্থান দিয়েছিলেন। প্রেম সম্পর্কে এই সর্বব্যাপী ধারণাকে হৃদয়ে ধারণ করেন কবি শাহীন সুলতানা। শাহীন সাহসী, শাহীন অকপট। বলতেই হয় এই সময়ে, এই বাংলায় কবি শাহীন সুলতানা রোমান্টিক পদাবলীর এক ধ্রুপদী ভাস্কর।
কবির এক অনবদ্য কবিতা -পঙতি দিয়েই প্রবন্ধটা শেষ করতে চাই—-
” কিছু তো চাই না কবি,
শুধু প্রেম দিও ঢেলে
আমার অস্তিত্ব লিখে দেব
তোমার দলিলে।