ওয়াইজঘাটের সেকাল একাল/আ‌নোয়ার ফরিদী

বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ওপারে যাওয়ার একটি ঘাটের নাম ওয়াইজঘাট। ঐতিহাসিকরা বলেন– ব্রিটিশ নীলকর জমিদার জেমস ওয়াইজ-এর নামেই এই নামকরণ। সেই সময় ঢাকায় তিনজন জেমস ওয়াইজ ছিলেন। প্রথমোক্ত নীলকর ছিলেন সোনারগাঁওয়ের জমিদার। আরেকজন ছিলেন ঢাকার সিভিল সার্জন। রুপমহল সিনেমা হলের পাশে তাঁর চেম্বার ছিল। আর তৃতীয়জন ছিলেন ঢাকা কলেজ-এর অধ্যক্ষ। এজন্য এই তিনজনকে ত্রিরত্ন বলে অভিহিত করা হতো।

ঘাটের পাশেই এক একর এগারো কাঠা জমির উপর রয়েছে কূখ্যাত জমিদার জেমস-এর রংমহল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ১৯৫৫ সাল থেকে এই ভবনটি ব্যবহার করছে।

পুরনো ঢাকার সদরঘাট মোড় থেকে একটি রাস্তা পটুয়াটুলি হয়ে সোজা চলে গেছে ইসলামপুরের দিকে। এরই মাঝামাঝি গিয়ে অধুনালুপ্ত মুন-স্টার হলের সামনে দিয়ে সোজা নদীর পাড়ে গিয়ে রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে এরই নাম ওয়াইজঘাট।

হাজারীবাগ থেকে মিলব্যারাক পর্যন্ত প্রায় শতাধিক ঘাট রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘাটগুলো হচ্ছে হাজারীবাগ শ্মশান ঘাট, সেকশন ঘাট, চম্পাতলীর ঘাট, ইমামগঞ্জ ঘাট, সোয়ারি ঘাট, নলগোলা ঘাট, মিটফোর্ড ঘাট, বাবুবাজার ঘাট বাদামতলী ঘাট, ওয়াইজ ঘাট, সিমসন ঘাট, শ্যামবাজার ঘাট, মিলব্যারাক ঘাট, ফরিদাবাদ ঘাট ইত্যাদি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সদরঘাটে কোনো টার্মিনাল ছিল না। লঞ্চ ভিড়তো সরাসরি নদীর পাড়ে। মানুষ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতো। শ্যামবাজার থেকে সোয়ারিঘাট পর্যন্ত পুরো এলাকাটি দিনের বেলায় থাকতো জমজমাট। চলতো হাজারো মানুষের আনাগোণা।

কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল ওয়াইজঘাট। গভীর রাত পর্যন্ত সরব থাকতো এলাকাটি। কারণ, এই সড়কে ছিল দুটি বনেদি সিনেমা হল, প্রায় ১০/১২টি মদের দোকান (এর মধ্যে একটি আবার কেরু কোম্পানির এজেন্ট), দুটি পতিতালয়।

সোনার দোকানের কারিগর, বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী, কার্গোর কোম্পানিগুলোর দালাল, ডকইয়ার্ডের শ্রমিক, চোর-বাটপাড়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যাপারিদের হৈ-হল্লায় সরগরম হয়ে থাকতো পুরো এলাকা।

এরমধ্যে ব্যতিক্রম ছিল বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান হোটেলগুলো। নিউ-উজালা হিন্দু হোটেল, নিউ ভোলা বুড়িগঙ্গা হিন্দু হোটেল, ফরিদপুর মুসলিম হোটেল, ঢাকা পোর্ট নাজমা বোর্ডিং ইত্যাদি বাহারি নামের হোটেল। এদের সুনাম ছিল অবিদিত। মূলত বিভিন্ন জেলা আসা বড় বড় ব্যাপারিরা সখের বশে এসব হোটেলে রাতযাপন করতেন। ওই এলাকার পুরনো মানুষদের কাছ থেকে জানা যায় ব্রিটিশ আমলে নদীতে ৫০/৬০টি ভাসমান বোর্ডিং ছিল। এরপর রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি আধুনিক হোটেল হওয়ার পর এগুলোর সংখ্যা কমতে শুরু করে।

ব্যাপারিদের জন্য রান্না করা হতো নানারকম বড় মাছ। যা স্বাদে-গন্ধে ছিল অতুলনীয়। নদীর উপর ভাসমান এই হোটেলগুলোর পাশেই সিমসনঘাট। এই ঘাট সংলগ্ন রাস্তার পাশেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আবাসিক হোটেল শংকর বোর্ডিং, তৃপ্তি হোটেল, সেতারা বোর্ডিং, খায়ের বোর্ডিং ও মদিনা হোটেল। মফস্বল থেকে থেকে আসা আইনজীবী, বড় ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবীরা নানা কাজে রাজধানী ঢাকায় এসে এসব হোটেলে অবস্থান করতেন। বাংলার নবাব বলে খ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন–‘আমি জামালপুর থেকে ঢাকায় এসে তৃপ্তি হোটেলে থাকতাম’।

ভাসমান হোটেলগুলোর এখন আর অস্তিত্ব নেই। হোটেলগুলো যেখানে ছিল সেখানে গড়ে উঠেছে বর্তমান টার্মিনাল। ফলে হোটেলগুলো লুপ্তপ্রায়। তবে বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন মিটফোর্ড হাসপাতালের উল্টোদিকে পাঁচটি ভাসমান হোটেল খুঁজে পাওয়া গেল। এই পাঁচটি হোটেল হচ্ছে ফরিদপুর বোর্ডিং, শরীয়তপুর বোর্ডিং, উজালা হিন্দু হোটেল, জমির মিয়ার হোটেল এবং বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং। বেশিরভাগ বোর্ডিংয়েই কোনো কাস্টমার নেই।

ফরিদপুর বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার মোস্তফার ভাষ্যে জানা গেল, তিনি বিশ বছর ধরে এখানে চাকরি করছেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েন নি। মোস্তফা আরো জানান তিনি যখন এখানে চাকরি করতে আসেন– তখন এতো খারাপ অবস্থা ছিল না।

এর কারণটা কি। তিনি জানালেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পঁচা পানি! নদীর পানি এতোটাই পঁচেছে যে, বোর্ডিং তো দূরের কথা নদীর দুপাশের দুই কিলোমিটার পর্যন্ত এই দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। দুই পাড়ের মানুষ নদীর এই বিষাক্ত পানির কারণে নানারকম রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বুড়িদের নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে একসময় এই রাজধানী ঢাকা শহরও মরে যাবে।

আলোকচিত্র: রিংকু চন্দ্র দাস।