বন্ধু হরিচরণ কর্মকার/ নাসির আহমেদ কাবুল

আমা‌দের বন্ধু হ‌রিচরণ কর্মকার,
স্কু‌লের শেষ বে‌ঞ্চে মুখগুঁ‌জে ব‌সে থাক‌ত ক্লা‌সে এ‌সে।
পড়া পার‌ত না ব‌লে শ্যামকান্তি দেউ‌রি স্যার
কান ধ‌রি‌য়ে ও‌কে বে‌ঞ্চের ওপর দাঁড় ক‌রি‌য়ে রাখতেন;
শা‌ন্তিরঞ্জন স্যার ছি‌লেন ওর যম!
রোজ রোজ ওকে দি‌য়ে টিচারস রুম থে‌কে বেত আ‌নি‌য়ে
ও‌কেই পেটা‌তেন বিজ্ঞা‌নের কো‌নো সূত্র ওর
মুখস্ত হ‌তো না ব‌লে!
কী করে মনে থাকে ওসব! ও তো বিজ্ঞানী হতে চায়নি;
হতে চেয়েছে বাউল-বিবাগী সংসার ছাড়া
সঙ্গীত সাধক!
তাও হ‌তে পা‌রে‌নি হ‌রি, হ‌য়ে‌ছে গহনা তৈ‌রির কা‌রিগর!
সবার কি আর সব ইচ্ছা পূরণ হয়?
আমারও হয়‌নি কোনওকা‌লে।

হ‌রিচর‌ণের জন্য আমার খুব কষ্ট হ‌তো;
বাদাম চক‌লে‌টের ভাগ দি‌য়ে ওর কষ্টগু‌লো
মু‌ছে দেয়ার চেষ্টা করতাম আ‌মি; আমার সেই
ছে‌লে‌বেলার দুরন্ত দিনগু‌লো মা‌ঝে ম‌ধ্যে ঝি‌মি‌য়ে
পড়ত হ‌রিচর‌ণের ক‌ষ্টে। হ‌রি, আমার বন্ধু
কান ধ‌রে বে‌ঞ্চের ওপর দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাক‌তে থাক‌তে
আমার দি‌কে তাকাত চু‌রি ক‌রে;
মিট‌মিট ক‌রে হাস‌ত সে, অথচ আমার দুই চোখ
জল-ছলছল হ‌তো; বু‌কের ম‌ধ্যে দুম‌ড়ে-মুচ‌ড়ে যেত।
সে স‌বের খোঁজ হ‌রিচরণ জানত না কো‌নো‌দিনই।
হ‌রিচরণ অ‌নেক খোঁজই জানত না আমার,
তবু আমরা বন্ধু ছিলাম!

হঠাৎ ক‌য়েক‌দিন ক্লা‌সে নেই হ‌রি, জ্বরটর হ‌য়ে‌ছে হয়ত।
দুচার দিন গে‌লে আবার ক্লা‌সে আস‌বে ভে‌বে স্ব‌স্তি খুঁ‌জি।
হঠাৎ শুনলাম হ‌রির বাবা দেহত্যাগ ক‌রে ওপা‌রে
চ‌লে গে‌ছেন!
হ‌রি ব‌লে, ‘ জা‌নিস না বাবা স্ব‌র্গে চ‌লে গে‌ছেন!
আর পড়াশুনা হ‌বে না আমার!’
সেই প্রথম হ‌রির চো‌খে জল দে‌খে হঠাৎ ও‌কে
জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে‌ছিলাম বু‌কের ম‌ধ্যে।
ভা‌লোবাসার মানুষ‌কে বু‌কের ম‌ধ্যে জ‌ড়ি‌য়ে ধরা যে কত সুখের, কত স্ব‌স্তির; সেই প্রথম জানলাম।

দুরন্ত কৈ‌শো‌রেই প্রেমে প‌ড়ে‌ছিলাম এক‌টি
চঞ্চলা কিশোরী কা‌লো মে‌য়ের;
গোল্লাছুট খেল‌তে গি‌য়ে সাগ‌রিকায় ওর কান ছিঁড়ে গে‌লে
সবাই ওকে ‘কানছেঁড়া মি‌লি’ বলে ডাকতো-
আমি কষ্ট বুকে চেপে ওর নাম রেখেছিলাম ‘অনামিকা’!
কাজী নজরুলের কবিতা থেকে নামটি নিয়েছিলাম।
অথচ কানছেঁড়া মিলি কোনোদিনও ওকে দেওয়া আমার নামটা জানতে পারেনি!
জানতে পেলে রাগ করত বা হাসত, এসব ভেবে ভেবে
ছেলেবেলা থেকে কখন যেন যৌবনে পা দিলাম।
ছেলেবেলার মিলি হারিয়ে গেল যৌবনের উত্তাল তরঙ্গে,
হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেলো ওর!
আর আমি হলাম ঘরছাড়া!

আমার এসব ব্যক্তিগত খবর জানত না হরিচরণ।
অথচ কতদিন না খেয়ে থেকেছে ওরা –
ওর মা, ছোট বোনসহ তিনজ‌নে !
আমাকে জানাতো ম্লান মুখে।
আমি হাঁ করে গিলতাম ওর কথাগুলো; বুকের মধ্যে কান্নার ঢেউ উ‌ঠে কষ্টগুলো ওর সঙ্গে মিশে যেত;
সে কথাও জানত না ওরা!

না খেয়ে থাকতে থাকতে কঙ্কালসার হরি মায়ের গহনা বিক্রি করে
গহনা বানানোর দোকান খুলে বসল একদিন।
বলল, গ‌ণেশ ঠাকু‌রের আশীর্বাদ পে‌য়ে‌ছি আ‌মি,
গহনা তৈ‌রি‌তে লাভ হ‌চ্ছে বেশ; দোকানে আসিস, গল্প করব তোর সা‌থে।’

আমাদের কতশত গল্প হতো, সুখের, দুঃখের, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির।
তার মাঝে আগুনে পোড়ানো স্বর্ণের টুকরো যখন সালফিউরিক অ্যাসিডে ডুবাত হ‌রি
‘চুক’ করে শব্দ হতো হঠাৎ। আমি সেই শব্দ বার বার শোনার অ‌পেক্ষায় থাকতাম।
`চুক` শব্দ‌টি কেন ভা‌লো লাগত, সে কথা নি‌জেও জা‌নি না আ‌মি। অ‌নে‌কেই জি‌জ্ঞেস করত,
বল‌তে পা‌রি‌নি কখনও।
কিছু কিছু ভা‌লোলাগা আর ভা‌লোবাসার কারণ
খুঁ‌জে বের করা ক‌ঠিন সবার কা‌ছেই।

হরি ওর প‌কেট থে‌কে বি‌ড়ির প‌্যা‌কেট বের ক‌রে বলত
‘বিড়ি খাবি নাকি একটা-কারিকর বিড়ি?’
আমি সিগারেট খাই, ক্যাপস্টান; পয়সা না থাকলে খাই না;
তবু হরির দেয়া কারিকর বিড়িতে আমার আপত্তি থাকত না।
বিড়ি ঠোঁটে পুড়ে কো‌রো‌সিনের ম্যাচলাইটে ধরাতাম;
কতদিন বিড়ির ছাইয়ে জামাকাপড় পুড়ে গেছে,
কতদিন কাশতে কাশতে হয়রান হয়েছি;
সেসব পুরোনো হলেও ম‌নের ম‌ধ্যে গেঁথে রেখেছি
খুব যত্ন করে।

আমার কোনোকিছুই যত্নে থাকে না, সবকিছু এলোমেলো।
এই যেমন লেখার টেবিল, কলম, ঘড়ি বা চশমা-
এমন কি কতজনকে হারিয়ে ফেলি সম্পর্কের দুর্বোধ্য ব্যকরণে!
কিন্তু হরি, আমাদের ক্লাসের শেষ বেঞ্চের নিশ্চুপ সেই ছেলেটি-
যে কি না না খেয়ে থাকতে থাকতে মায়ের গহনা বেচে
গহনা তৈরির দোকান দিয়েছিল, যার পকেটের কারিকর বিড়িতেও
আমার কোনো আপত্তি থাকতো না,
সেই হরিকে আমি হারাইনি কোনোকালে।

কবি আঞ্জুমান আরা খান

সকল পোস্ট : আঞ্জুমান আরা খান