সিকদার আমিনুল হকের একগুচ্ছ কবিতা

আধুনিক বাংলা কবিতার ষাট দশকের অন্যতম র্শীর্ষ কবি সিদকার আমিনুল হক-এর ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আগামীকাল ১৭ মে। ২০০৩ সালের এই দিনে কবি, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট সিকদার আমিনুল হক ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। কবি সিকদার আমিনুল হক ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকায় চলে আসেন। স্কুল জীবনেই তার লেখালেখি শুরু হয়। কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাংলাদেশ ও পশ্চিবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য ম্যাগজিনে তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকে। কবিতার পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ে প্রবন্ধ,কলাম লিখেন তিনি। ষাট দশকে পরাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিয়য়েও তিনি অসংখ্য কবিতা লেখেন। তার কবিতায় স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ,সাধারন মানুষের জীবনযাপন,তাদের সুখ-দুঃখ এবং মানবিকবোধের নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ষাট দশকের খ্যাতিমান কবিদের অন্যতম সিকদার আমিনুল হক সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন। দৈনিক দেশ গ্রুপের‘ বিপ্লব’ নামে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। নিজের সম্পদনায় ‘ স্বাক্ষর ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা দীর্ঘদিন প্রকাশ করেন।

কবি সিকদার আমিনুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দূরের কার্নিশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্য ও অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে -তিন পাঁপড়ির ফুল (১৯৮২), আমি সেই ইলেকট্রা (১৯৮৫), বহুদিন অপেক্ষা বহুদিন অন্ধকার (১৯৪২), পত্রে তুমি, প্রতিদিন জলে (১৯৮৭), এক রাত্রি এক ঋত ু(১৯৮৬), সুপ্রভাত এই বারান্দা (১৯৯৩), কাফরার জামা, রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা, কবিতা সমগ্র, গদ্য সমগ্র, নির্বাচিত কবিতা।

কবি ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও বেশকিছু পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

তোমার বারান্দা

নিঃশব্দ বারান্দা থেকে তুমি কি দেখতে চাও জানি;
আমাদের খঞ্জ গলি মেঘভর্তি নর্তকী আকাশ,
যেন বালা সরস্বতী জীবনের আহত ঝিলিক
দিয়ে যায় সুন্দরের হাতে হাতে। যাকেই দেখো না
তুমি, আমি কিন্তু তোমাকেই দেখি, তোমাকে ছাড়া তো
কিছুই দেখি না! সারাক্ষণ তোমার বারান্দা আর
যখন থাকো না নিজে, ফ্ল্যাট বাড়িটার পৌঢ় ছায়া
গিলে খাই চোখ দিয়ে; আর তুমি আসছো না

যেন কত যুগ থেকে। দেখলাম শীর্ণ নর্দমায়
বেড়ালের চলাফেরা – দাঁত ভাঙা প্লাস্টিক চিরুনি
কুড়োচ্ছে রাস্তার ছেলে। কাকের প্রখর চোখে ঘৃণা,
চিঠি বিলি করে ডাকঘর, প্রবীণারা ব্যবহৃত
পুরোনো বোতল তুলে রাখে; শুধু অপচয় হতে
দেখি আমাদের প্রেম, শিশুর বলের মতো ছুটে
গিয়ে মজা ইঁদারার তলদেশে কেবল লুকোয়।
আহত নিঃশব্দ আমি এই দৃশ্যে গাঢ় হয়ে থাকি।

তোমার বারান্দা যেন দূরবীন এই পৃথিবীর
আর তাই সহজেই, তোমার দেখার সব বস্তু
উঠে আসে নিমেষেই; কিন্তু তুমি অস্বচ্ছ এখনো
আমার দৃষ্টির কাছে। বহু দূরে আলস্য জড়ানো
শরীরের প্রগতিকে মনে মনে জানাই স্বাগত।
তুমি কি দেখো না মেয়ে, মাঝে মাঝে বহু রাত হলে
হরিণের মতো প্রমত্ত জ্যোৎস্নার নিরাপদ নিচে-
আমাদের দুটো বাড়ি মুখোমুখি জলপান করে?

কাতরতা তোমাকে দেখি না

এলাম সে-পাড়া ছেড়ে। তোমাকে দেখি না বারান্দায়
সেই থেকে। দীর্ঘদিন! –সারা বিশ্বে, শহরে ও গ্রামে
এসেছে বিস্তর ভালো-মন্দ দিন। একভাবে ভালো
নয় কিংবা মন্দ দীর্ঘস্থায়ী নয়। দিন ও রাত্রির
দরজা খুলেছে হেসে আমাদের পুরোনো পৃথিবী।
কেবল একক অন্ধকারে আমার এদিন যায়
অশরীরী মৃত্যু ভয়ে স্তব্ধ স্নিগ্ধ গভীর সন্ধ্যায়,
অথবা ঝড়ের দিনে ছিন্নভিন্ন নির্বোধ মাস্তুলে।

মনে কি তোমার পড়ে? তুমি একা, বেলা দশটার
বারান্দায় স্থির দূত। বাড়ি নয়, যেন গন্ডোলায়
ভাসছে তোমার নিঃসঙ্গতা, বিশ্রী শূন্যতায় তুমি
ভাঁজে ভাঁজে ক্লান্ত শত খন্ড যেন ছাদে ও কার্নিশে।
অযথা গলির রৌদ্রে ভাদ্রের ভ্যাপসা মেঘলোকে
ছড়ায় বিনষ্ট ঘ্রাণ। তোমাকে নিস্পন্দ শব জেনে
উড়ে আসে কিছু কাক। চুতুর্দিকে খাঁ-খাঁ শূনত্যার
তুমুল দাপটে দগ্ধ ছন্নছাড়া দশটার বেলা।

জানি না তোমার নাম; শুধু দেখি ঠান্ডা রন্ধনশালায়
তুমি হেঁট হয়ে বসা। বিদঘুটে পুরুষের ট্রাউজার
দিচ্ছো শুকোতে বাইরে, কিংবা পিঠ আলস্যের
রৌদ্রে মেলা, কৌচে বসে পড়ছো, গ্রীবার মরূদ্যানে
দুপুরের প্রসন্নতা। এত স্নিগ্ধ, এত তন্দ্রাময়
তোমার বিশ্রাম আর নিশ্চিত যান্ত্রিক ওঠা-বসা।
ক্রমাগত দেখে দেখে আমি জানি তোমার সময়
মুহূর্ত মাসের যাবতীয় দৃশ্য, বাস্তবিক আমি।

এখানে আকাশই দেখি। পচে যাওয়া শাদা মেঘ,
দীর্ঘ অনুজ্জ্বল বেলা, অপ্রস্তুত গলির প্রহর।
চিলের নাছোড় ডানা, অকস্মাৎ কোনো স্নানঘরে
মধ্যবয়স্কার মুণ্ডু। ভবঘুরে বাস ফিরে আসে
স্বেচ্ছায় নিজস্ব স্টপে, সব দেখি তোমাকে দেখি না।
আজকাল বই নিয়ে তুমুল শিল্পিত হতে চাই,
লিখি, পড়ি, ছবি দেখি, বাখের সোনাটা শুনে শুনে
প্রথামতো ভালোবাসি গন্ধভরা আপাতত দিন;
স্বচ্ছন্দে নিয়মে চলে, হাত, জিভ, প্রত্যঙ্গের কাজ –
কোথাও বিরতি নেই, কাতরতা তোমাকে দেখি না।

বেলা দশটার কবিতা

সবাই চলেছে কাজে; আমার সহধর্মিণী সেও!
কিন্তু কী আমার কাজ? জানি না কোথায় পৌঁছবো;
উত্তর চল্লিশে পৌঁছে আজও এই মতিচ্ছন্নতার
বুঝি না উৎস কী যে, আমি নই জনপ্রিয়, লিখে
ঘরে বসে বই পড়ে, যে-গ্রন্থ হবে না ছাপা, তার
আপাদমস্তক খুঁটে, পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে টেবিলে
কেন যে প্রহর যায় পরিণামহীন। সকলের
এত কাজ, আকস্মাৎ আমি কেন এতটা স্বাধীন?

আমার সঙ্গীও আছে। এক কাক। তাকে ভয়ানক
স্তব্ধ মনে করি। বিরক্ত হয় না, কার্নিশেই বসে থাকে।
নিতান্ত মাছের লেজ, পোড়া রুটি, বিস্কুটের গুঁড়ো
হৃষ্ট চিত্তে বেছে নেয়। কাজ শেষে আবার ঝিমোয়।
যান্ত্রিক বাঁচার কাজে এই একাগ্রতা, হতে পারে
চেষ্টাকৃত, জন্মলব্ধ, যা-ই হোক, কিন্তু তা নিশ্চিত।
এদিকে আমার কাজ প্রায়শই দুর্ঘটনা আর
দৈবের নির্ভর। – ক্রোধে বিদ্ধ হয়ে তাকে ঈর্ষা করি।

আহত পাওয়া

তোমার চেয়ে দুরূহ যে তাকেই পাওয়া সহজ হলো
এই নিখিলে সহজ পাওয়া যায় না
নির্বিচারে গ্রহণ করার সেই অধিকার জর্জরিত
সমগ্রতার একটু ফাঁকি সয় না।
তোমার মতো আলিঙ্গনে উন্মাদনার দুর্গ তুলে
সরল হাতে শুল্ক নিতে চায় না,
বুকের ক্ষত গাঢ় হলে উপাস্য সে রৌদ্র জলে
এমন শর্ত অনিচ্ছুকের রয় না।
দুই মুকুরে আঞ্চলিকি, কেউ প্রিয় তার কেউ অতিথি
প্রচলিত, করে না বঞ্চনা
তোমার কাছে আহত হলে, অধিকারের দৈর্ঘ্য বাড়ে
এই হিসেবে সবারই পরগণা।

ভাষাতত্ত্বের এক ছাত্রীকে

গল্প পড়ে কিন্তু তত লাগে নাই ভালো!
তবু ধন্যবাদ দিই, মামুলি লেখার
এই লাভ! তর্ক হয়, দুরন্ত বুকের
ঝড় দেখে বুঝে ফেলি তুমি যে মেয়েই!

যাকে তুমি শ্লেষ ভাবো, আমি ভাবি মেঘ।
প্রেমে-পড়া অসম্ভব; তবু স্থির রক্তে-
জেগেছিলো কোলাহল, আমার বয়সে
এটুকু যথেষ্ট খুকি, তুমি সুখে থাকো।

শুনেছি ভাষার যন্ত্রে তুমি আজ বলি,
লেখা কি আসল কাজ? প্রেমে-পড়া ভালো!

নিজ মেরুতে দাঁড়িয়ে

লোকে যা বলে তা সত্য নয়-
চেনা প্রতীক এক দশকের ঢলে
কোথায় চলে যায়-
গেরুয়া জল পায় না ছোঁয়া তোমার পদযুগল!
সত্যি নাকি প্রভু?
খুঁজতে হবে-
কিন্তু এইভাবে তো নয়!

গ্রীষ্মের প্রতিভা

অ্যাসফল্ট চষে-চষে দেখা হলো গ্রীষ্মের প্রতিভা!
রাস্তায়, দোকানে, পার্কে, কুকুরের পিঠে। শীততাপ
ঘর ছাড়া সবাই প্রচন্ড এলোমেলো। এত রুষ্ট
শহরে আসেনি সন্ধ্যা নির্বাতাস আজকের মতো।
প্রখর অরুচি দেখি শরীরের, সমীচীন জেনে
বাক্যালাপও প্রায় বন্ধ। কেউ যদি ঘর্মাক্ত চুম্বন
হুল্লোড়ে ফেলেও আসে, প্রাপকের হয় না বিনোদ।
চেনা তৃষ্ণা উড়ে যায়, ওষ্ঠের দূরত্বে তান্তালস

সহজে পায় না মুক্তি। এই ক্রোধ চলে সারা রাত;
ট্রাউজার, গেঞ্জি ভিজে, সিদ্ধ হয় স্তনের গৌরব।
বেসিনে চমক নেই, প্রিয় গ্রন্থ, শুভেচ্ছার চিঠি
বিরক্তির উৎস মাত্র। কাক নয়, গ্রীষ্মই সরব-
অশ্লীল, কামুকতুল্য,- গনগনে নীলিমার নীল
যেন রুদ্র নজরুল, গান ভুলে রৌদ্রঝলসিত।

মন্তব্য করুন