সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা

হঠাৎ নীরার জন্য

 

বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল

                                   স্বপ্নে বহুক্ষণ

দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারেদিকচিহ্নহীন

বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে

তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের

নীল দুঃসময়ে

 

দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি

আজই কি ফিরেছো?

স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন

তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে

তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,

অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা

 

এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম

ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়

বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা

নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি

এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে

বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার শরীর ভ্রমণে

পুণ্যবান হবো

 

বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,

                                   বাড়িতে আসবেন!’

 

রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল

একটু দাঁড়াও’, কিংবাচলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে

কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে

সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন

ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাতপায়ে ছুটে

পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্টের দরজায়

 

বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।

তুমি

আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশে মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।

বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনো ভাবি অপার্থিবা কিনা।

সারারাত পৃথিবীতে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে, স্থির জানি, তুমি দেবে ক্ষমা

তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।

যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে
অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।

মন্তব্য করুন