আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে/রানা ইবনে আজাদ

আজ অমাবস্যা। ঘুট ঘুটে আধার চারিদিকে, রাত ১১.৩০ শহরের বাতি সব ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে, ডাঃ মোকাম্মেল তার কেবিনে বসে আছে, তার ভয়ানক সাইনাসের ব্যাথা হচ্ছে। শিউলি দুই এক বার এসে উঁকি মেরে গেছে, শিউলি ডাঃ মোকাম্মেলের এসিস্টেন্ট, সাহস করে বলতেও পারছে না কিছু, ফ্রন্ট ডেস্কে অনেক্ষণ ধরে বসে থেকে সাহস করে একবার ডাঃ মোকাম্মেলের কেবিনের দরজা ঠেলে মাথাটা কেবল ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলো সে বাড়ি যেতে পারে কি না, মোকাম্মেলের লাল চোখ দেখে সাহসে কুলিয়ে ওঠে নাই।

ড্রাইভার জাফর ঘরের এক কোনে বসে পুরোনো একটা পেপার পড়ার ভান করছে আসলে সে পেপারের কোনা দিয়ে শিউলি কে দেখছে, শিউলি ব্যাপারটা জানে, কিন্তু স্যারের ড্রাইভার বলে কিছুই বলতে পারে না। শিউলি ডেস্কে বসে বিরক্তি নিয়ে পা নাচাচ্ছে, আজ শিউলির জন্মদিন, কথা ছিল হারুনের সাথে ফুচকা খেতে নিউমার্কেট যাবে, সেই সন্ধ্যা থেকে হারুন তার অফিসের সামনে ঘুর ঘুর করছে, অনেকবার মানা করেছে শিউলি এই রকম অফিসের সামনে না আসতে, হারুন কথা শোনার মানুষ না, তার একটাই বক্তব্য, শিউলির অফিস দেখতেও তার ভালো লাগে, আসলে হারুনের কোন কাজ নাই, সন্ধ্যার পর শিউলির সাথে সময় পার করাটাই তার এখন মূখ্য কাজ। শিউলির খারাপ লাগছে এতক্ষন ধরে হারুন বাহিরে হাঁটছে তাকে ডেকে অফিসে এনে বসাবে এটাও পারছে না। জাফর ইবলিশটা বসে আছে! ঠিক স্যার কে বলে দিবে। স্যার কে না বললেও ম্যাডাম কে তো অবশ্যই বলবে, মোকাম্মেল সাহেবের স্ত্রী মমতাজ বেগম , অসম্ভব সন্দেহ বাতিক গ্রস্থ মানুষ, সারাক্ষন শিউলির উপর নজর, শিউলির পাক্কা ধারনা জাফর কে রাখা হইছে শিউলিকে পাহাড়া দেয়ার জন্য। মমতাজ বেগমের ধারনা শিউলি মোকাম্মেল সাহেবের সাথে শোয়ার জন্য অস্থির, সুযোগ পেলেই শুয়ে পড়বে। সেইদিন অফিসে এসে তো একরকম বলেই গেলো, অফিসে বোরকা পরে আসতে।

জাফর মুখ ভর্তি পান নিয়ে সুরুত সুরুত শব্দ করে জিজ্ঞাসা করলো, মিস শিউলি স্যারে কি আজ যাইবে ?

আমি কি করে বলবো, বিরক্ত হলো শিউলি।

আপনে তো স্যারের খাস লোক তাই জিগাইলাম, মনে কিছু নিয়েন না, লাল পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসতে লাগলো জাফর, হারুন বাইসাব অনেক্ষণ হলো বাইরে চরকির মতন ঘুরপাক খাইতাছে হ্যারে বিদায় করেন, যেমনে ঘুরতাছে কয়দিন তো পক্ষি হইয়া উইড়া যাইবো।

চমকে ওঠে শিউলি, বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, এই ইবলিশ হারুন কে চিনলো কি করে, নিশ্চই এই ব্যটা হারুনের সাথে দেখছে, আজই হারুন কে বলতে হবে যেন এই লোকের কাছ থেকে দূরে থাকে, ব্যাটা মহা ধরিবাজ কি বলতে কি বলে কে জানে, এখনি বলা দরকার কিন্তু হারুনের তো মোবাইল নাই, কতবার বলেছে যে একটা মোবাইল কিনতে, দরকার হলে আমি টাকা দেই, না তার সেই একই উত্তর সে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে থাকতে চায়, মোবাইল নাকি জেলখানায় যাওয়ার প্রথম দরজা। এই যে এখন শিউলির হারুন কে জানানো দরকার যে সে যেতে পারবে না তারপর রাত ১১.৩০ কোন ফুচকা ওয়ালা নিশচই বসে নাই তাদের জন্য! খুব চিন্তা হচ্ছে, স্যার ও বলে না কিছুই।

অফিসের মেইন দরজায় কে যেন টোকা মারছে, ধীরে ধীরে, মনে হচ্ছে বেশ দ্বিধা নিয়ে নক করছে, এত রাতে কোনো রুগীর আসার কথা না, কে হতে পারে, শিউলি উঠে গিয়ে দরজা খুলতে যাচ্ছিলো, জাফর উঠে বললো আপনি বহেন, এত্ত রাইতে ক্যাঠায় আইলো, দরজা খুলে জাফর অবাক, হারুন দাঁড়িয়ে আছে। ওই দেখ কেডায় আইছে, আমগো হারুন বাইসাপ নি।

শিউলি ধরমর করে লাফিয়ে উঠে তোতলাতে লাগলো, তুমি কি ব্যাপার?

হারুন অত্যান্ত লজ্জিত মুখে বললো ইয়ে মানে আমি কি তোমাদের বাথরুম টা ব্যাবহার করতে পারি, অনেক্ষণ ধরে দুই নম্বর টা পাইছে, এখন আর চেপে রাখতে পারছি না!

তুমি টয়লেট করার জন্য এই সাত তালা হেটে উঠছো? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো শিউলি।

মিয়া তারাতারি যান, আমনে তো প্যান্ট মাইখা ফেলবেন, খিক্ খিক্ করে হাসতে লাগলো জাফর। শিউলি ম্যডাম আপনের বন্ধু ভি বহুত আজিব আছে, নিচে এক জায়াগায় বইলেই কামডা হইয়া যায়, হ্যায় সাত তালায় উইঠা আইছে কাম সারতে, হা হা হা, অট্ট হাসিতে ফেটে পরলো জাফর।

শিউলির মুখ লাল হয়ে গেলো লজ্জায়, হারুনের উপর ভয়াবহ রাগ হচ্ছে। মাথা নিচু করে মনে মনে হারুনের মাথা ফাটাচ্ছে। আড়চোখে দেখলো জাফর মিটিমিটি হাসছে তারদিকে তাকিয়ে। এটা দেখে শিউলির ইচ্ছা হলো মরে যেতে। আজ হারুনের নিস্তার নাই।

হাত মুছতে মুছতে শিউলির ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো হারুন, তোমাদের টয়লেট তো দেখছি একদম বাদশাহী আয়োজন, কমোড দেখে ইচ্ছাই হলো না ওখানে বসতে, চাপ না থাকলে বসতামই না। এমন শুভ্র সুন্দর টয়লেট আমি আমার জীবনে দেখি নাই, আমার তো ভয়ই করছিল ভেঙ্গে না ফেলি।

দাঁতে দাঁত চেপে শিউলি রাগ কন্ট্রল করলো, তোমার কাজ শেষ হলে যেতে পারো, আমার দেরি হবে যেতে , আড়চোখে চেয়ে দেখলো জাফর হা করে ওদের গিলছে।

কিছুই হয় নাই এমন একটা ভাব দেখিয়ে হারুন বসে পড়লো সোফায়, তুমি কি আমার উপর রেগে আছো, আমি সেই বিকেল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

শিউলি কোন উত্তর না দিলো না, রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, তুমি যাও আমি তোমার সাথে পরে দেখা করবো।

হারুন উঠে দাড়ালো। কাচুমাচু ভঙ্গিতে শিউলির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, ইয়ে মানে তুমি যদি একটু কষ্ট করে নিচে আসতে তাহলে ভালো হতো।

কেনোনিচে কেনো যাবো? ঝাঝালো গলায় উত্তর দিলো শিউলি।

তুমি আজ ফুচকা খেতে চাইলে , তোমার দেরি দেখে এক ফুচকা ওয়ালা কে নিচে বসিয়ে রেখেছি তুমি গেলেই ফুচকা খাওয়া হতো,বেচারীর এক মেয়ে , মেয়ের নাম লতা, বউ নাই, দেরি হচ্ছে দেখে আমাকে বললো যেন তোমাকে নিয়ে আসি। ওর মেয়েটা রাতে ভয় পায়।

অবাক হয়ে হারুনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো শিউলি। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, কান্না পেয়ে গেলো, কান্না লুকাতে হাত দিয়ে চোখ ডলে বললো, না আমি যেতে পারবো না, তুমি যাও। শিউলির খুব ইচ্ছে করছে হারুন কে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে।

হারুন অসহায়ের মত শিউলির দিকে তাকিয়ে থাকলো, এই অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটা কি করে এমন কঠোর হতে পারে এটা সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। তার ইচ্ছে হচ্ছে শিউলির গালে ঠাস করে একটা চড় বসাতে, তার সন্দেহ আসলেই সঠিক, শিউলি ওই মোকাম্মেল নামক বুড়া ছাগলটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। জাফরের দিকে একবার তাকালো হারুন, জাফর উদ্দেশ্য মূলক চোখ টিপি দিয়ে তাকে যেতে বললো। শেষ চেষ্টা করলো হারুন।

তুমি একবার গেলেই পারতে, মুখ নিচু করে বললো

তুমি কি শুনতে পাও নাই আমি কি বলেছি, আমার কাজ আছে, মাথা নিচু করে চোখ আড়াল করলো শিউলি, তারা গালা ভেঙ্গে কান্না আসছে, তার ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে হারুনের হাত ধরে বলে চলে আমরা পালিয়ে যাই এখান থেকে ।

আমাকে কিছু টাকা দেবে, মেজাজ খারাপ করে বললো হারুন, ইদ্রিস মিয়াকে দিতে হবে, ওর মেয়ে টা অসুস্থ, আমার কাছে মাত্র দুই টাকা আছে।

কতো টাকা, শিউলি কান্না চেপে রাখলো।

পাচশত টাকা, ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত চুলকাতে লাগলো হারুন ।

বলেন কি মিয়া বাই ফুসকার দাম পাচশো টাকা, ব্যাটায় আপনারে সিদা পাইয়া ঠকাইতাছে, জাফর সোফার উপর আধশোয়া হয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে বললো।শিউলী ভুরু কুঁচকে জাফরের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে হারুন কে দিলো, যাও টাকা টা নাও, পাশ থেকে একটা ব্যাগ উঠিয়ে হারুন কে দিয়ে বললো এই শার্ট টা তোমার জন্য।

চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গেলো হারুন, শিউলি মাথা নিচু করে ডেস্কে বসে থাকোলো। জাফর কিছুক্ষণ পর পর খুক খুক করে কাশতে লাগলো, পাত্তা দিলো না শিউলি, তার এখন আত্মাহত্যা করতে মন চাচ্ছে, মরার আগে ইচ্ছে হচ্ছে পাশের ফুলদানি দিয়ে জাফরের মাথায় কসে একটা বারি দিয়ে মাথা ভেঙ্গে গুড়া গুড়া করে ফেলতে। ব্যাটা ইবলিশের বাচ্চা!

দরজা ফাঁক করে ক্লান্ত পায়ে এক লোক এসে বসলো, তাকে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত ও ক্লান্ত লাগছে। ডেস্কের উপর মাথা নিচু করা শিউলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আসে পাশে তাকাতে লাগলো, তার অনেক পিপাসা পেয়েছে, এখানে পানির কোন ব্যাবস্থা দেখতে পাচ্ছে না। জাফর কে দেখে জিজ্ঞাসা করলো ডাক্তার সাহেব কি চেম্বারে আছেন?

জ্বী না, এত রাইতে আপনে কি চান? দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ভুরু কুচকে আগন্তকের দিকে তাকালো জাফর।

ও আচ্ছা , ঘুরে দাঁড়ালো আগন্তক, আমি তাহলে যাই।

শিউলি ঘরের ভেতর অন্য মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে মাথা উঁচু করে আগন্তক কে দেখে চমকে গেলো। মলিন মুখটা দেখে ওর মায়া হলো, যেন অনেক রাত ঘুমায় নাই, চোখ কটকটে লাল।

না না স্যার আছেন, জাফর সাহেব কেন মিথ্যা বলছেন? আপনি বসেন, স্যার কে আমি বলছি, আপনার কি কোন এপয়েন্টমেন্ট ছিলো? জ্বী না!

তাইলে যান গা, স্যারে এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া রুগি দেখে না, মুখ দিয়ে অদ্ভুত মিচমিচ শব্দ বের করতে লাগলো জাফর। মাইয়া মানুষ বেশি ফটর ফটর করে, তুই জানস আমার পাওয়ার! আহাম্মক হারুইন্যারে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইতাছস কিচ্ছু বুঝি না ভাবছো, আবার স্যারের লগেও ফস্টি নস্টি হালার জামানা, বেকতে সুজুগ লয় মনে মনে শিউলির মুন্ডুপাত করলো জাফর।

শিউলি আগন্তকের দিকে তাকিয়ে দেখলো লোকটা বেশ ক্লান্ত, সে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো আপনি বসেন আমি স্যার কে বলি, দয়া করে আপনার নাম টা বলবেন?

রুগী, আমি একজন রুগী

বুঝলাম না স্যার, হতভম্ব শিউলি

আপনার স্যারকে বলেন একজন রুগী এসেছে।আসাদুজ্জামান অস্থির ভাবে হাত নারাতে লাগলেন।

শিউলি স্লাইড ডোর ঠেলে উঁকি মেরে একবার দেখলো।

স্যার একজন রুগী এসেছেন।

বলে দাও রুগী আসিবার পুর্বে ডাক্তার মারা গেছে, চোখ বুজে চেয়ারে ঢুলতে ঢুলতে পা নাড়াতে লাগলেন ডাঃ মোকাম্মেল। *

স্যার একটু যদি দেখতেন, উনি বেশ অস্থির হয়ে আছেন, ইতস্তত ভাবে দেয়ালে নখ খুটতে লাগলো শিউলি।

তোমার কোন আত্মীয় ? ভুরু কুঁচকালেন ডাঃ মোকাম্মেল।

না স্যার,
তাইলে বিদায় করো।

মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকলো শিউলি, ও জানে একটু পরেই শিউলিকে বলবে যাও রুগী কে আনো আমার দেশ উদ্ধারের কাজ সফল করি।

শিউলি আমি তোমাকে যেতে বলেছি, ও ভাবে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?

স্যার , পুর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মোকাম্মেলের দিকে।

আচ্ছা যাও , এই কিন্তু শেষ রুগী, এর পর রুগী নাই তুমিও নাই , তোমার চাকরি খতম, উইথাউট নটিশ।ইউ আর স্যাকড।

শিউলি মুচকি হাসি দিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো, আগন্তকের দিকে তাকিয়ে মিস্টি করে হাসি দিলো, যান স্যার ডাকছেন। উনি একজন বিশ্ব বিখ্যাত ডাক্তার, আপনি জলদি সুস্থ হবেন।

আগন্তক উঠে ঘার নিচু করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কেবিনে ঢুকে গেলো, মনে হলো বিশাল কোন বোঝা তার ঘাড়ে, বোঝার ভারে চলতে পারছেন না।

জাফর শিউলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলো, ছেরি এত্ত হাসতাছে ক্যান, ডাক্তার সাবে কি দিছে নি কিছু ডলা মলা, জামা জুমা তো কুচকায় নাইক্কা। টিপি টুপি দিবারো পারে, জামানা পুরাই আখেরি হয়া পড়ছে। মরলে বাঁচি, তয় মরার আগে এই ছেরির খাউজানী কমাইতে হইবো। সরু চোখে শিউলিকে পর্যেবেক্ষণ করতে লাগলো।

জাফর সাহেব আপনাকে স্যার গাড়ি বের করে নিচে অপেক্ষা করতে বলেছে, যদিও ডাঃ মোকাম্মেল এমন কিছুই বলে নাই তার পরেও বললো, জাফরকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না।

জাফর দুই হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙলো, মোড়াতে মোড়াতে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। স্যাররে জিগামু কখন বের হইবো, স্যার কইলে যাই, জাফরের ধারনা শিউলি মিথ্যা বলছে। দুইডা পুরুষের সাথে রঙ ঢঙ করার তালে আছে ছেরি ।

শিউলি ইন্টারকমে হাত দিয়ে বললো আমি স্যার কে ধরিয়ে দেই ফোনে, কি বলেন?

না থাউক গা, যাই হাত পা ব্যাদনা করতাছে, একটু ব্যাম বুম করন লাগবো।

হ্যাঁ যান, গাড়ি রেডি করেন, আপনি গাড়ি পরিষ্কার করেন কম, ভয়ানক দুর্গন্ধ আসে, গাড়ি পরিষ্কার করেন।

তোর বাপের গাড়ি নি, মনে মনে গালি দেয় হারুন, হালার মাতারি নাক টিপলে এখনি হিকনি বাইর হয় হ্যায় আমারে কয় গাড়ির থেকে গন্দ আহে, বেডি তুই গাড়িতে বাপের জন্মে চড়ছস? তুই গাড়ির কি বুঝস। আর চোখে তাকিয়ে মনে মনে গজগজ করতে করতে হারুন চেম্বার থেকে বেড়িয়ে গেলো।

শিউলির খুব ইচ্ছে হচ্ছে জানালায় দাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে হারুন আছে না চলে গেছে, নিচের ঠোঁট কামড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ ভাবলো, এতক্ষণে হয়তো হারুন চলেই গেছে, মনের মধ্যে ক্ষীণ একটু আশা আছে যে হারুন নিচেই আছে, পুরানা অভিজ্ঞতা তাই বলে।

ঝলমলে সকালে রাস্তা পার হচ্ছেন ডাঃ মোকাম্মেল, প্রচন্ড জোরে ঢাকার লক্কর ঝক্কর মার্কা একটা ট্রাক তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো, তিনি ধরমরিয়ে জেগে গেলেন, রুগী আসতে বলে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন, অপ্রস্তুত হয়ে মৃদু হাসি দিলেন, চোখ কচলে চেয়ে দেখলেন সামনে একজন বসে আছে, মুখে অনেক দিনের না কাটা দাড়ি, ঠোঁট দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা সিগারেটের পোকা, খানিক উশখুশ করেছন, বারবার ঠোঁটে হাত বুলাচ্ছেন। সিগারেটের পিপাসায় কাতর, তিনি সামনের কেইস থেকে সিগারেট বের করে বাড়িয়ে দিলেন, আগন্তক জ্বল জ্বলে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো এর পর হাত ইশারায় মানা করে দিলো।

আপনি আমাকে কিছু বলবেন? জিজ্ঞাসা করলো ডাঃ মোকাম্মেল,

জ্বী, মাথা নাড়ালো অগন্তক, দুই হাত কচলাতে লাগলো, দেখে মনে হচ্ছে দাস তার প্রভুর সামনে বসে আছে ভাবখানা এমন প্রভুর সামনে বসে থাকার মত অনেক বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে, যা শাস্তি দিবে তাই সে মাথা পেতে নেবে।

আপনার কি বসতে সমস্যা হচ্ছে?

জ্বী না, মাথা নাড়লো আগন্তক

আচ্ছা ঠিক আছে, কি বলবেন বলুন, আপনাকে আমি বেশি সময় দিতে পারবো না

ইয়ে মানে আমি একটা খুন করেছি আজ কিছুক্ষণ আগে।

বলেন কি, আতঙ্কিত হয়ে চমকে উঠলেন মোকাম্মেল, তার হার্ট বিট ১৮০ তে লাফ দিয়ে উঠলো।

জ্বী, আমার স্ত্রী, অনেক পাজি মহিলা, তার গলা টিপে তাকে খুন করেছি।

আপনার তো থানায় যাওয়া উচিত, এটা তো পুলিশ কেস, আমি তো ভাই পুলিশ না।

কিন্তু আমার স্ত্রী যে বললো আমাকে আপনার এখানে আসতে, খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে আছেন আগন্তক।

শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলেন ডাঃ মোকাম্মেল, ভারী নিঃশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করলেন। এতোক্ষণ তিনি অগন্তককে ভালো করে লক্ষ্য করেন নাই, এই বার ভালো করে তাকালেন, ঝকঝকে সুন্দর আকাশী কালারের ছাপা একটা শার্ট পরে আছে, মাথার চুল এলোমেলো, ঠোঁট শুকনা, বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন। চোখ দুইটা লাল যেন কেউ লাল কালি ঢেলে দিয়েছে। খুক করে একটা কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে মোকাম্মেল সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন,

ভাই আপনার নাম কি?

তন্ময়, তন্ময় কবির।

আচ্ছা,

আচ্ছা না, আমি চিত্র পরিচালক তন্ময় কবির।

ও, দুঃখিত আমি চিনতে পারলাম না, অনেকদিন বাংলা সিনেমা দেখি না তাই। জ্বী তন্ময় সাহেব বলুন আপনি আপনার স্ত্রী কে কি করে খুন করলেন।

বললাম তো মাথায় বারি দিয়ে মেরেছি, লম্বা শক্ত লোহার রড দিয়ে, মহিলা আমাকে অনেক কষ্ট দিছে আর পারবে না। সব ফিনিশ করে দিলাম, বিশ্বাস করেবেন না এই এত্ত বড় এক হাত জিব বের হয়ে গেছিলো। চোখ বড় বড় করে বলতে লাগলো। ওই জিব দিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলেছে জিবটা কেটে ফেলা উচিত ছিলো মায়া করে ছেড়ে দিয়েছি। মায়া খুব খারাপ জিনিস, একবার হলেই খালি বাড়তে থাকে। জানেন এখন না খুব মায়া হচ্ছে মায়ার জন্য। লোহার সাথে অনেক মগজ লেগে গিয়েছিলো, এখনো হাতে লেগে আছে। হাত দু’টো শার্টে বার বার ঘসতে লাগলেন, দুই হাত নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকলেন, নাক কুঁচকে ফেললেন,
আচ্ছা মগজে কি খুব বাজে গন্ধ হয় ? হাতের গন্ধ শুকতে লাগলো তন্ময়।

মায়া কে?

ওই যে বললাম না মায়া আমার স্ত্রী। মৃত আর কি।

ও আচ্ছা, তো কি দিয়ে মারলেন

আপনি খালি ভুলে যান, গলায় ছুড়ি চালিয়ে মেড়েছি। দর দর করে রক্ত বের হচ্ছিলো, সারা মেঝে রক্তে ভরে গিয়েছিলো, ইটালিয়ান টাইলসের মেঝে পিছল হয়ে গিয়েছিলো, আমি তো পা পিছলে পরেও গিয়েছিলাম। এই যে দেখেন কাপড়ে রক্ত লেগে আছে, তন্ময় তার কাপড় টেনে টেনে দেখাতে লাগলেন।

আপনার স্ত্রী আপনাকে কখন আমার কাছে আসতে বলেছেন, মারা যাওয়ার আগে না পরে।

ওই তো যখন আমি ও কে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম তখন সে বললো,

কি বললো?

আমার হাতে আপনার কার্ড দিয়ে বললো আপনার সাথে দেখা করতে।

আপনার স্ত্রীর নাম টা যেন কি ?

আপনাকে কতবার বলতে হবে আমার স্ত্রীর নাম ছায়া, রেগে গিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলেন তন্ময়।

ছাদ থেকে ধাক্কাটা কি করে দিলেন সামনে থেকে না কি গল্প করেত করতে পেছন থেকে ধাক্কা টা দিয়েছেন

আচ্ছা আপনি কিসের ডাক্তার, সামান্য কথা মনে রাখতে পারেন না, আপনাকে আমি কি একবারো বলেছি ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছি, আমি ওকে আগুনে পুড়িয়ে মেড়েছি, কেরসিনের আগুন। এর পর যদি ভুলে যান আমি আপনাকে খুন করবো। ভয়ানক রেগে গেলেন তন্ময়।

চিল্লাচিল্লি শুনে দরজার ও পাশ থেকে উঁকি দিলো শিউলি। হাত নেড়ে ওকে আশ্বস্ত করেলন ডাঃ মোকাম্মেল। মৃদু গলায় বললেন চা দাও আমাদের দুই জনকে।

আমি চা খাই না, রেগে আছেন ভদ্রলোক।

আমি খাই মুচকি হাসি দিলেন ডাঃ মোকাম্মেল, আপনি ঠান্ডা লেবুর শরবত খান তো ?

হ্যাঁ তা খাই, বুঝলেন এই শরবত টা যা একটু খাই, তাও ওই পেত্নী দেখতে পারতো না, আমার নাকি এসিডেটি হয়, গ্যাস বের হয়, আপনি বলেন এই যে আমি বসে আছি একটাও গ্যাস মেড়েছি? অবশ্য আমার বাসার কাজের মেয়ে টা পাদ বলে হা হা হা হা । বলে স্যারের পাদে অনেক গন্ধ। দিছি একদিন থাপ্পর, এক থাপ্পরে তার সামনের দুইটা দাঁত পরে গেছে। দেখতে খুবি ভয়ানোক, দাঁত ছাড়া মেয়ে মানুষ শাঁকচুন্নির মত দেখোতে, আমার ওই মেয়ে কে দেখলেই বমি পেত।

শিউলি এক কাপ চা আর শরবত নিয়ে ঢুকলো, শরবত তন্ময়ের দিকে এগিয়ে দিতেই তন্ময় শিউলির দিকে তাকিয়ে জোরে হাসি দিলো।

আয় হায় কে এটা, শিউলি না ?

হ্যাঁ ভাইজান আমি শিউলি, আপনি ভালো আছেন, বউদি কেমন আছেন ?

তোর বউদি খতম, মেরে ফেলছি, গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বললো। এই বার তুই আমার সাথে থাকতে পারবি, তোর আর মেসে থাকতে হবে না। বকুল কিন্ত খারাপ ছিলো না কি বলিস, খালি তোকে একটু দেখতে পেতো না, তাই তো শেষ করে দিলাম। এখন ভাই বোন জিন্দাবাদ।

তোমার ভাই হয় ? ডাঃ মোকাম্মেল শিউলির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন

জ্বি, মাথা নিচু করে বললো শিউলি।

তখন যে বললে তূমি চেন না, কেন বললে ?

স্যার আপনি চাকরিতে জয়েন করার প্রথম দিনই বলে দিয়েছেন ব্যাক্তিগত রুগী আপনি দেখেন না। তাই বলি নাই।

আচ্ছা, তুমি ও বসো, চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন শিউলি কে, তুমি জানো তোমার ভাবী কে তোমার ভাই খুন করেছে।

বলেন কি? চমকে তাকালো তন্ময়ের দিকে শিউলি।

হ্যাঁ, সম্ভাবত আজই খুন করেছেন, তুমি কি আমার কোন কার্ড ওকে দিয়েছিলে

জ্বী, লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো।

না ঠিক আছে লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। তুমি কি বলতে পারবে তোমার ভাবীর নাম কি , ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছি উনি বিভিন্ন নাম বলছেন।

জ্বী, ভাইয়া বৌদিকে বিভিন্ন নামে ডাকে। বৌদির আসল নাম ছন্দা।

তোমার ভাই বললেন তিনি চিত্র পরিচালক

জ্বী না, ভাইয়া তেমন কিছুই করেন না।

কেন, বিস্মিত হলেন ডাঃ মোকাম্মেল।

আসলে বৌদি ভাইয়াকে ঘরের বাহিরে তেমন একটা যেতে দেন না।

আচ্ছা তা হলে সিনেমার পরিচালক ব্যাপার টা কি

ভাইয়া অনেক সিনেমা দেখেন, ছোট বেলা থেকেই সিনেমা বানানোর সখ ছিলো।

হুম, বুঝলাম, তন্ময় সাহেব, ডাঃ মোকাম্মেল ফিরে তাকালেন তন্ময়ের দিকে, ততোক্ষণে তন্ময় ঘুমে কাদা। মৃদু নাকও ডাকছে। শিউলি আস্তে তন্ময়ের হাত স্পর্শ করে ডাকলো ভাইয়া, ওঠ, তন্ময় নড়েচড়ে জেগে উঠলো। হাত দিয়ে গাল মুছে শিউলির দিকে তাকিয়ে বললো কি রে কখন এসেছিস?

তুমি আমার চেম্বারে এসেছো।

তুই আবার চেম্বার দিলি কবে, উকিল নাকি তুই? তুই তো এম এ পরিক্ষাটাই ঠিক মত দিলি না। সব আমার দোষ বুঝলি, ওই ডাইনিটার জন্য আমি সব হারালাম, তোকে, মাকে সব্বাইকে। দাঁতে দাঁত পিষে হাত দিয়ে চেয়ারে ঘুশি মারতে লাগলো তন্ময় কবির।

তন্ময় সাহেব, আপনার স্ত্রীর লাশ টা কি করেছেন, জিজ্ঞাসা করলো মোকাম্মেল।

আছে খাটের নিচে ফেলে এসেছি।

তো এখন কি করতে চান?

সেটা আপনি বলবেন, উকিল আপনি আমি না !! হেসে জবাব দিলো তন্ময়। আজকালকার লোকজন ঠিকমত পড়াশুনাটাও করে না।

স্যার কিছু মনে করবেন না, লজ্জিত গলায় বললো শিউলি

ঠিক আছে সমস্যা নাই, তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আশ্বস্ত করলেন ডাঃ মোকাম্মেল। তন্ময় সাহেব চলেন আপনার বাসায় যাই, দেখি আপনার স্ত্রীর লাশে কোন ঠিকানা লাগাতে পারি কি না।

সেই ভালো, লাফ দিয়ে উঠলো তন্ময়, চলেন জলদি চলেন, অনেক ক্ষুধা লেগেছে বাসায় গিয়ে খেতেও হবে। বুঝলি রে শিউলি আজকাল তোর বৌদি যা রান্না করে অখাদ্য, মুখে নেয়া যায় না। এর থেকে দুই চামুচ গু খাওয়া অনেক ভালো। অনেক মিনারেল ও পুষ্টি আছে শুনেছি।

তোমার ভাই কি করেন, শিউলির দিকে তাকিয়ে আবার৷ জিজ্ঞাসা করলেন ডাঃ মোকাম্মেল।

জ্বী কিছুই না, ইতস্ততা করে বললো শিউলি,ভাইয়া ঘরজামাই হিসেবে বউদির সাথেই থাকতেন।

তোমার সাথে তোমার বৌদির সম্পর্ক কেমন?

ভালোই আর দশটা ননদ ভাবীর মতই।

কখনো তোমাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছেন?

না তবে উনি আমাদের ভালো চোখে দেখতেন না। আমরা তাদের বাসায় যাই এটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু গেলে আদর করতেন, কখনোই থাকতে বলতেন না, আসলে উনি চাইতেন না আমরা থাকি।

জাফর কে গাড়ি বের করতে বলো, আমরা তোমার ভাইয়ের বাসায় যাবো।

গাড়ি উত্তরার রাস্তায় আশি কিলোমিটার স্পীডে চলছে। জফরের মেজাজ বিশাল খারাপ, শালার চাকরী, উস্টামারি তোর কপালে, যারে না ধরি হাতে তারে এখন পায়ে ধরতে হয় মনে মনে গালির বন্যা ছুটিয়ে যাচ্ছে। কারণ গাড়িতে উঠেই মোকাম্মেল গাড়ির ভেতর গন্ধ পেয়ে একচোট কথা শুনিয়েছে, অথচ এই মোকাম্মেলের দাদারা অন্যের জমি হাল চাষ করে খাইছে , এখন দুইটা পয়সা হইছে তার ঠ্যালাতেই বাচে না। শালা বৌ থুইয়া পর মাইয়ার লগে আকাম করস শরম নাই, ব্যাডা বুড়া হইছে তাও খাইছলত যায় নাই।

জাফর, বিরবির করে কথা না বলে গাড়ি সাবধানে চালাও। আমি জানি আমার পুর্ব পুরুষ তোমাদের জমি চাষ করছে এটা বার বার মুখস্ত করার কিছুই নাই। আধো চোখ বোজা অবস্থায় ডাঃ মোকাম্মেল ঝিমুতে লাগলেন।

না স্যার কি যে কন এই সব কথা কইয়া আমাকে শারমিন্দা করেন ক্যালা, জাফর চমকে উঠে থতমত খেল ।

তুমি তো ঢাকার লোক না এই ভাবে কথা বলো কেন?

স্যার যে দেশে যেমুন চল, আমি যাই বঙ্গে আমার কপাল যায় সঙ্গে।

কি ব্যাপার শিউলি মন খারাপ করে আছো কেনো? শিউলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো মোকাম্মেল

না স্যার এমনি, মাথা নিচু করে থাকলো শিউলি, আসার সময় দেখে এসেছে হারুন সেই ফুচকা ওয়ালা কে নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছে, ওকে গাড়ি করে বের হয়ে যেতে দেখেছে। নির্বাক চেয়ে থাকলো।

হালার খয়রাতী রাইত বিরাইতে রাস্তায় বইয়া করেডা কি ? জাফর আড় চোখে একবার শিউলির দিকে তাকিয়ে বেশ তৃপ্তির সাথে বললো, যেন এক প্লেট বিরিয়ানী খেয়ে বেশ মজা পেয়ে গেছে।

শিউলির খুব কান্না পাচ্ছে, হারুনের জন্য ও আবার তার ভাইয়ের জন্যও। হারুনকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে ওর একটুও ভালো লাগে নাই। বড্ড অসহায় লাগছিলো, এই ঝামেলা শেষ হলে স্যারকে বলে হারুনের জন্য একটা চাকরী খুঁজে দিতে হবে, চাকরী খুঁজে দিতে হয়তো পারবে, এখন সে করলে হয়, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবতে লাগলো।

শিউলি তুমি কি তোমার ভাইয়ের বাসা চেনো, জিজ্ঞাসা করলো মোকাম্মেল।

জ্বী স্যার চিনি, সাত নং সেক্টর পনের নং রোড চার নং বাড়ি, তিনতলা বাড়ি আকাশী কালারের।

তোমার ভাইয়ের প্রিয় রঙ তাই না? মৃদু হেসে বললো মোকাম্মেল।

জ্বী,বৌদি সব কিছুই আকাশী কালারের পড়ে। তার বাসার সব কিছুর রঙ আকাশী।

তন্ময় সাহেব

জ্বী স্যার?

আপনি আমাকে স্যার ডাকছেন কেনো?

আপনি শিউলির স্যার তাই আমারো স্যার।

আচ্ছা, অট্ট হাসিতে ফেটে পরলেন ডাঃ মোকাম্মেল, কেমন লাগছে এখন?

পিকনিক পিকনিক লাগছে, আমরা কোথায় যাচ্ছি স্যার?
এই মুহুর্তে আপনার বাসায় , আপনার স্ত্রীর লাশটার একটা ঠিকানা করা দরকার কি বলেন?
লাশের কথা শুনে জাফরের কান খাড়া হয়ে গেলো, তার প্রশ্রাব পেয়ে গেছে, তল পেট ভারী হয়ে আছে, লাশের কথায় সে চমকে উঠে দুই তিন ফোঁটা কাপড়ের মধ্যে ছেড়ে দিলো। আইজ কপালে জেলের ভাত আছে, উপায় নাই, কি দুঃখে এই পাগলের চাকড়ি নিছিলো এটাই চিন্তায় আসে না। শালার মোকাম্মেল তর জন্য আইজ যদি জেলে যাই তোর মাথায় থু দিমু।* সামনে এক মোড়ে দুই পুলিশের টহল দেখে জাফর ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলো, ঘাড় ফিরিয়ে মোকাম্মেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো স্যার লাশ কি গাড়িতেই আছে?

তুমি গাড়ি চালাও, সব কথা তোমার না শুনলেও চলবে।

জেলের ল্যাবড়া খাইতেই হবে, আজীবন পুলিশের ভয়ে কাবু থাকে জাফর আজ আর উপায় নাই মনেমনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।

৭ নং সেক্টর,১৫ নং রোড, ৪ নং বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে জাফর দরজা খুলে ভোঁ দৌড় দিলো, সে তার প্যান্ট ভিজিয়ে গাড়ির সিট কাভার ও ভিজিয়ে ফেলেছে। পুরো গাড়িতে প্রশ্রাবের গন্ধ।

দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখা গেলো দরজায় বিশাল তালা, নিচে কেউই ছিলো না, এই বাড়িতে কোন দারোয়ান নাই কেনো, মোকাম্মেল জিজ্ঞাসা করলো শিউলিকে।

স্যার বৌদি সুচিবায়ুগ্রস্থ তাই কেউই নাই।

কিন্তু দরজার তালা কি করে খুলবো

আমি খুলে দিচ্ছি, পেছন থেকে একটা কন্ঠ বলে উঠলো। **

চমকে সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখলো একজন অসম্ভব রূপবতী, তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মিস বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলা যায়। ডাঃ মোকাম্মেল যদি চ্যানেল আই এর এম ডি হতেন তিনি একটা প্রতিযোগিতা করে ভদ্র মহিলা কে মিস বাংলাদেশ উপাধি দিয়ে দিতেন। ভদ্রমহিলা এতটাই আকর্ষনীয় যে সবার মধ্যে কেমন একটা ঘোর কাজ করছে, মোটামুটি সবাই নিশ্চুপ কেবল তন্ময় বিরক্ত হয়ে হাত পা নাড়ছে।

কেমন আছো শিউলি?গম্ভীর গলায় দরজার তালা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাস করলো । জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাঃ মোকাম্মেলের দিকে তাকালো, আপনাকে তো চিনলাম না!

জ্বী আমি একজন ডাক্তার। হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়েও ফিরিয়ে নিলেন, আপনার স্বামী আমার ওখানে গিয়েছিলেন, তার সমস্যা সমাধানের জন্যই আসলে এসেছি। চলুন ভেতরে গিয়ে কথা বলি ।

না, মহিলা শক্ত গলায় বললেন, আমি যাবো না, আপনারা যান ভেতরে, ওকে তাড়াহুড়া করে বেড়িয়ে যেতে দেখে আমি এসে ঘর তালা দিয়ে যাই, বুঝতেই পারছেন কোন দাড়োয়ান আমি রাখি না।

ভদ্র মহিলা দরজা খুলে দিয়ে উপরে চলে গেলেন, একবার ফিরে দেখলেন তন্ময়ের দিকে, একজন মানুষ একজন মানূষ কে ঠিক কতটা ভালোবাসলে এই ভাবে তাকানো যায় তা ডাঃ মোকাম্মেলের জানা নাই।

তন্ময় সাহেব আপনার স্ত্রীর লাশ টা কোথায় আছে, আমাদের দেখিয়ে দিন

ওই তো সোফার নিচে, বেশ ভয়ে ভয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো

যান নিয়ে আসুন, আমরা অপেক্ষা করছি বাহিরে।

আমার ভয় করে, গলা কাঁপতে কাঁপতে বললো।

ভয়ের কি আছে, উনি এখন মৃত, ভয় নাই, যান নিয়ে আসুন, আমরা আজই লাশ টা ফেলে দিয়ে আসবো।

তন্ময় ঘরে ঢুকে সোফার পাঁশ থেকে কিছু ভাড়ি একটা কাধে টেনে তুললো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে লাগলো যেমন কুলি ভারী বোঝা টানে ঠিক তেমন করে।

আমি সাহায্য করতে পারি, এগিয়ে গেলো ডাঃ মোকাম্মেল

না না আমি পারবো, খারাপ মানুষের গন্ধ অনেক খারাপ হয় স্যার, আপনি সহ্য করতে পারবেন না।

অদ্ভুত ভাবে বাসি ফুলের গন্ধে ভরে গেছে চারিদিক। শিউলির ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে, মুখের রঙ ফ্যাঁকাসে। ডাঃ মোকাম্মেল শিউলির কাধে হাত রেখে বললো ভয় নাই, তুমি চাইলে থেকে যেতে পারো।

না, আমি ভাইয়ের সাথে যাবো, মাথা নাড়লো শিউলি

তন্ময় খুব কষ্ট করে এক এক ধাপ গুনে গুনে নামছে যেন বোঝার ভাড়ে তার দেহ বেঁকে গেছে। কিছুটা নেমে কাধ থেকে নামিয়ে টেনে নামাতে লাগলো। নিচে জাফর গাড়ি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেছে, তার লজ্জার সীমা নাই। প্যান্ট থেকে এখনো গন্ধ আসছে কিন্তু উপায় কি, হঠাৎ তার নাকে কর্পূরের গন্ধ এসে যেন ধাক্কা দিলো। ইন্নালিল্লাহ.. আইজ নিস্তার নাই, কোন বিপদে আছি আল্লাহই জানে। গাড়ির পেছনে লাশটা ঠেলে উঠালো তান্ময়। জাফরের দিকে এক গাল হাসি দিলো।

ড্রাইভার ভাই ভালো আছেন, আপনার দেখি ছোট বেলার মত হিসু করার অভ্যাস আছে।

জাফর কিছু না বলে গাড়িতে উঠে গেলো, তার অন্তর আত্মা বলছে আজ কিছু একটা হবে। শয়তানের পাল্লায় পড়েছে সে। আইজ মৃত্যু নিশ্চিত।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় গেটের কাছে এসে কি মনে করে ডাঃ মোকাম্মেল এক বার পেছন ফিরে তাকালেন, দেখলেন ছন্দা দাঁড়িয়ে আছে, চোখের কোল বেয়ে পানি পড়ছে। তার খুব ইচ্ছা হলো ছন্দার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন চিন্তা করবেন না তন্ময় ভালো হয়ে যাবে।

গাড়ি মিরপুর বেড়ি বাধের রাস্তায় চলছে। সবাই চুপ। খালি জাফর উসখুস করছে, গাড়ির মধ্যে মরা লাশ তার উপরে আবার কর্পুরের গন্ধ তার হাত ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসছে, মিন মিন গলায় বললো স্যার আজ আপনার জন্মদিন ছিল মেডামে কেক নিয়ে বসে আছেন, বাড়ি যাবেন না।

না আজ যাবো না। কিছু কিছু সময় অপেক্ষা ভালো জিনিস, করা উচিত

কিছুই ঢুকলো না জাফরের মাথায়, সব নষ্টের গোড়া এই বদ মাইয়া, এই মাইয়া স্যারের মাথা খাইছে, আবার বইছে কোথায় দেখছো একেবারে স্যারের কোলের মধ্যে। বদ মাইয়া।

শিউলি তুমি কি গান জানো জিজ্ঞাস করলো ডাঃ মোকাম্মেল।

জ্বি স্যার জানি,

হ গান তো জানবি, জানবি না !!! এখন গান গাইয়া ঢং করবি লীলা করবি শালার বদ মাইয়া

একটা গান গাও ।

জাফর সিডি প্লেয়ারে ক্যায়সে বানি গান বাজিয়ে দিলো, মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাল মেলাচ্ছে।

জাফর তোমার এই গান বন্ধ কর আমরা আজ সবাই শিউলির গান শুনবো, আজ আমার জন্মদিন, শিউলি এই উপলক্ষ্যে আমাদের গান শুনাবে। শিউলি গাও।

আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে—
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে

শিউলি চোখ বন্ধ করে গান গাচ্ছে, প্রকৃতি আজ দুয়ার খেলে দিয়েছে সব জ্যোৎস্না আজ পথে চাদর বিছিয়ে দিয়েছে অথচ আজ অমাবস্যা, প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়, মোকাম্মেল খুব করে চাইতেন তার জন্মদিনে তিনি তার স্ত্রীর হাত ধরে ঝকঝকে এক জ্যোৎস্না রাতে কোথাও লং ড্রাইভে যাবেন, করুনা থাকলে ভালোই হত, ফিরে যাওয়ার সময় করুনার জন্য এক গোছা শেফালী নিয়ে যেতে হবে, শিউলি আজ কি শেফালী ফুল পাওয়া যাবে, শিউলি গান থামিয়ে মাথা নাড়লো জানি না স্যার।

তুমি গান থামালে কেন, গাও , বেশ ভালো গান গাও তুমি!

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে—
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে

ডাঃ মোকাম্মেল চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন। তন্ময় আপনার স্ত্রীর লাশটা কি এখনো আছে?

জ্বি স্যার আছে, পঁচে গন্ধ আসছে, মানুষ পঁচা গন্ধ খুব খারাপ, স্যার গাড়িটা একটু দাড়া করাবেন আমি বমি করবো!

না গাড়ি চলতে থাকুক বমি পেলে গাড়ির ভেতরেই করবেন।

তন্ময় সাহেব আপনি আমাকে অযথাই স্যার বলছেন আমার একটা সুন্দর নাম আছে আকাশ, আমার মা রেখেছিলেন। আমাকে আকাশ ভাই বলতে পারেন।

জ্বি স্যার অবশ্যই ভাই বলবো। স্যার আমি বমি করলাম, ওয়াক ওয়াক করে বমি করে গাড়ির পেছন সিট ভাসিয়ে দিলো তন্ময়!

গন্ধ স্যার! অনেক গন্ধ!

শিউলি ভয়ে থর থর করে কাঁপছে, তার গলা ছেড়ে কান্না পাচ্ছে। সে দুই হাতে তার ভাই কে জরিয়ে ধরে আছে।

কবি আঞ্জুমান আরা খান

সকল পোস্ট : আঞ্জুমান আরা খান

মন্তব্য করুন