কাজী ফাতেমা ছবি ও তার তিনটি পোষা বিড়াল

শুরুতেই কবি কাজী ফাতেমা ছবির পরিচয় দিচ্ছি। পেশাগত জীবনে তিনি একজন ব্যংকার। আছেন বাংলাদেশ ব্যংকের প্রধান কার্যালয়ে উপ-পরিচালক পদে। তার নিজের ভাষায় লেখালেখি অনেকটা শখের বশে শুরু করেছেন। সহজ সরল ভাষায় দৈনন্দিন ঘটনা বা নিজের অনুভুতি অথবা কল্পনার জাল বুনে লিখে ফেলেন।

নিজস্ব মুল্যায়নের সাথে কাজের যথার্থ মিল রয়েছে কবির। তিনি ইতিমধ্যে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তিনটি কাব্যগ্রন্থ। এই মেঘ এই রুদ্দুর, মন পবনের নাও এবং ঝরা পাতার নুপুর। আমার আজকের বই আলোচনায় কাজী ফাতেমা ছবির তিনটি কাব্য গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করবো। একাধিক কাব্যগ্রন্থ এক সাথে পাওয়ার কারণে নয়, সঙ্গত কারণেই তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করছি। কারণটা আলোচনায় পরবর্তীতে যুক্ত হবে।

কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে কাব্যগ্রন্থের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। কাব্যগ্রন্থ এই মেঘ এই রুদ্দুর, প্রকাশ কাল অমর একুশে বই মেলা ২০১৬। প্রকাশ করেছেন প্রকৌশলী শামিম রহমান আবির। প্রকাশক কুঁড়েঘর প্রকাশনী লিমিটেড। সুন্দর বাধাই ও মানসম্মত পিন্টিং এর কাব্যগ্রন্থ এই মেঘ এই রুদ্দুর এর প্রচ্ছদ করেছেন দেশের স্বনামধন্য প্রচ্ছদ শিল্পী চারু পিন্টু। মুল্য নির্ধারন করা হয়েছে ২৫০ টাকা। স্বত্ব নিয়েছেন কবি নিজেই।

পরের কাব্যগ্রন্থ মন পবনের নাও। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। প্রকাশ করেছেন একে এম নাসির উদ্দিন আহমেদ, প্রকাশন জলছবি প্রকাশনী। সুদৃশ্য প্রচ্ছদ করেছেন খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী সোহাগ পারভেজ। এই কাব্যগ্রন্থ উতসর্গ করেছেন মোঃ আবদুর রহমান কে। যার কাছে তিনি ছন্দ মাত্রা শিখেছেন। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ঝরা পাতার নুপুর। প্রকাশ করেছেন কুড়েঁঘর প্রকাশনী, প্রকাশক প্রকৌশলী শামিম রহমান আবির। প্রচ্ছদ করেছেন জিয়া রায়হানের তোলা ছবি থেকে। প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০১৭।

বেলা দ্বি প্রহর যবে চারদিক নিস্তব্ধ নির্জন

ঝিরঝির বয়ে যায় নরম আবেশে পবন। (ঝরা পাতার নুপুর)

কাজী ফাতেমা ছবির ভিন্ন তিনটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলাদা করে আলোচনার তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। কারন তিন কাব্যগ্রন্থ পড়ার মত একটা গড়পড়তা ধারনা বদ্ধমুল হয়ে যায়। ব্যক্তিগত ভাবে কাব্যগ্রন্থের বাইরেও তার কবিতার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে। ফলে কবির কবিতা লেখার বিষয়, ধরনের উপর ধারনা আমার কাছে পরিস্কার। কবির লেখার মুল বিষয়, মানুষ ও প্রকৃতি এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম। কবিতা সংকলনের ক্ষেত্রে কবি আলাদা কোন বিষয় বস্তু নির্ধারন করেননি ফলে তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা আলোচনা এক সাথেই করা সম্ভব।

কবি কাজী ফাতেমা ছবির কবিতায় একটি বিষয় বেশ লক্ষনীয়। তিনি প্রায় সব কবিতায়ই ছন্দোবদ্ধ রাখেন বা রাখার চেস্টা করেন। মুলত প্রতিটি লাইনের শেষে ছন্দমিল বেশ পরিলক্ষিত হয়েছে। আমার মনে হয় কবি কাজী ফাতেমা ছবি ছন্দের ব্যপারে বেশ চিন্তিত। ফলে তিনি সকল ক্ষেত্রেই লাইনের শেষে ছন্দমিল রাখতে চান। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে কিছু কিছু কবিতায় ছন্দমিল রাখতে গিয়ে কাব্য রস দুর্বল করে ফেলেছেন। আবার কিছু কিছু কবিতাকে কবি কবিতা বলেছেন কিন্তু আসলে সেই কবিতা হলো নাকি ছড়া হয়ে গেলো তা নিয়ে সংশয় রয়ে যায়।

যেমন

অস্থির হবো চঞ্চল হবো

তোমার জন্য ব্যকুল হবো

এমন কথা ভেবো নাকো

দূঃস্বপ্নটাই মনে আঁকো।(হতে চাও কি দীর্ঘশ্বাস?)

কবিতায় লাইনের শেষে ছন্দ মিল থাকা জরুরী নয় তবে যদি ছন্দমিল দেয়া যায় তাহলে আবৃত্তি করতে সুবিধা হয়। এটাও সত্য যে অনেক সময় শেষে ছন্দমিল না রেখেও সুন্দর কাব্যদোতনা সৃষ্টি করা সম্ভব।

শুধু কাজী ফাতেমা ছবি নন। অনেকের ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। যারা একটা ধারা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। এটা করতে গিয়ে কেউ অহরহ দুর্বোধ্য শব্দের ব্যবহার করেন, কেউ অতি সহজ সরল শব্দ আবার কেউ মুক্ত গদ্যাকারে লেখার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ ছন্দমিল রাখতে গিয়ে কাব্যের তাল হারিয়ে ফেলেন।

কবিতার ক্ষেত্রে একটা বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে। তা হলো মনে রাখা প্রয়োজন অতীতে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। প্রেম,দ্রোহ, প্রকৃতি, নীতিবাক্য, দর্শন ইত্যাদি নানান বিষয় কবিতায় যুক্ত বিযুক্ত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে লেখা লাখ লাখ কবিতায় সকল বিষয় লেখা হয়ে গেছে। তাহলে নতুন করে কবিতায় আমরা কি লিখব? কেন লিখবো? কবিতায় নতুন কি কি নিরীক্ষা বাকী রয়ে গেছে?

অতীতে লেখা হয়েছে এমন কোন বিষয় নিয়ে নতুন করে লিখলে সেইটা হয় অনুকরণ হবে, প্রভাবিত হবে নয়তো দ্বৈততা সৃস্টি হবে। যদি একই ধরনের লেখা পাশাপাশি উপস্থাপিত হয় তাহলে পুর্বাপর কবিতার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। ফলে নতুন করে কি লিখবো কেন লিখবো এই নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।

কবিতায় নতুন কোন বিষয় লিখতে হবে নয়তো নতুন ভাবে উপস্থাপনা করতে হবে। ঠিক কত গুলি কবিতা লেখা হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশী গুরুত্বপুর্ণ কয়টি কবিতায় পাঞ্চ লাইন সৃষ্টি হয়েছে। কবিতায় পাঞ্চ লাইন থাকা খুবই বাঞ্চনীয়। পাঞ্চলাইন গুলি পাঠক মনে রাখবে। তা উপদেশ আকারে হোক, কোটেশন হোক, নীতিবাক্য হোক কিংবা শ্লোগান হিসেবেই হোক, অন্তত ভালবাসি এর মত বহু ব্যবহৃত শব্দই হোক। অন্তত একটা লাইন কিংবা উপস্থাপনার কারণে একটা শব্দও পাঠকের মনে গেথে দেওয়ার ক্ষমতা কবিতার থাকতে হবে। হতাশ হওয়ার জন্য বলছি না। কবিতায় অমরত্ব খুব সাধারণ ঘটনা নয়। আবার অসম্ভবও নয়। একজন কবিতা একহাজার কবিতা লিখতে পারেন হতে পারে তার দশটি কবিতা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়টি কবিতা আমাদের মনে আছে তার লেখার তুলনায়।

আরো একটা বিষয় বলা যেতে পারে। তা হলো কবিতাকে কালে আটকে দেয়া। অনেকেই প্রশ্ন করেন কবিতা স্থান কাল আছে কিনা। কবিতায় স্থান বা কালের সীমায় আটকে দিলে সেই কবিতা স্থান চ্যুতির সাথে সময়ের সাথে হারিয়ে যায়। হতে পারে সমসাময়িক কোন ঘটনা থেকে সৃষ্ট কবিতাও সর্ব কালের জন্য প্রযোজ্য হয়ে উঠতে পারে তার উপস্থাপনার রীতির কারণেই।

আবারো কবি কাজী ফাতেমা ছবির কবিতায় ফিরে আসি। কবিতার প্রতি কবি দরদ আছে, আন্তরিকতা আছে, কবিতা নিয়ে কবির পরীক্ষন আছে। তবে প্রকাশের আগে পরীক্ষন গুলো প্রকাশ করা যাবে কিনা তা নিয়ে ভাবার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। আবার যদি বুঝতে না পারেন কোনটা পরীক্ষন তাহলে কবিতা নিয়ে আরো বেশী পড়াশোনার প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা আলোচনায় দেশের স্বনামধন্য কবি নুরুল হুদা বলেছেন অতীত বর্তমানের কবিতা পড়তে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হতে হয় নতুন কি লিখবো। একজন বা দুজন কবির কবিতা পড়লে তার প্রতি প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাবিত হওয়াটা দোষের নয়। তবে প্রভাব থেকে বের হতে হলে অবশ্যই একাধিক কবির কবিতা নিয়ে পড়াশোনা করা জরুরী। এমন কবিতা চাই যা যখনই পড়া হোক মনে হবে এ যেনো এই সময়েরই কবিতা।

আমি পাঠ আলোচনা শেষ করবো। মুলত গতাণুগতিক যেভাবে বই আলোচনা করি কাজী ফাতেমা ছবির কাব্যগ্রন্থ তিনটির বেলায় সেই ভাবে আলোচনা হয়তো হয়নি। তবে এতে নতুন কিছু যুক্ত হলো। এই কাব্যগ্রন্থ গুলো আলোচনা করতে গিয়ে অনেক কবিরা সাধারণত যে ভুল গুলো করেন তা নিয়ে আলোচনা হলো। কবিকে হতাশ করা আমার উদ্দেশ্য না। হতাশ হওয়ার কোন কারণও নেই। আমি মনে করি কবিতায় নিরীক্ষার অনেক জায়গা রয়েছে। চেষ্টা করলে সে এই জায়গা গুলো অনায়াসে দখল করে নিতে পারে। আমি মুক্ত আলোচনা করতে চেয়েছি এই জন্য যে এখান থেকে এমন কিছু বিষয় বের হয়ে এসেছে যা আমার নিজের জন্য বেশ কাজে লাগবে। সব শেষে কাজী ফাতেমা ছবির একটি কবিতাংশ দিয়ে শেষ করবো।

রিক্ত বনবীথিকার শাখে জেগেছে ঐ কচি নব কিশলয়

মৃদুমন্দ বয় বায় দখিনা লাগে বুঝি সর্বাঙ্গে শিহরণ।

আবরণ ভেঙ্গে গিয়ে ধুলোর-গাছে অপরুপ সবুজ মায়া

প্রশান্তির নিকেতন বনান্তরালে ডাকে কুহু কুহু কোকিল

অশোক পলাশ বনে রক্তিম রঙ্গেতে রাঙ্গিয়েছেন বিধাতা।

(ঐ এলোরে বসন্ত// এই মেঘ এই রুদ্দুর)

মন্তব্য করুন