পাঁচ গেরিলার মুক্তিযুদ্ধ : নাসির আহমেদ কাবুলের কিশোর উপন্যাস

লুৎফুর রহমান পাশা ।। সময়টা বেশ উত্তাল। চারিদিকে এগার দফা আন্দোলনের সাজ সাজ রব। স্কুল কলেজ থেকে শুরু সাধারণ মানুষদের ভিতরে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। স্কুলে কোমলতি ছেলেদের মগজের ভিতরে যে দীপ্ত নিউরন রয়েছে তাতেও স্বাধীকারের তৃষ্ণা জেগে উঠতে শুরু করেছে। বাদ যায়নি মঠবাড়ীয়ার স্কুলের ছাত্ররাও। তাদেরই একজন ক্লাশ নাইনের ছাত্র ইউছুফ। জাগ্রত চেতনা আর বিবেকের হাতছানি যাই হোকনা কেন অন্যান্যদের চাইতে তার মধ্যে এই তাড়না জন্ম হয়েছে সকলের আগে। পড়ালেখায় যতটা ভালো নিজেকে নিয়ে দেশকে নিয়ে ভাবনার তাড়নাও তার চাইতে বেশী প্রবল। তার এই তাড়না বোধ ছড়িয়ে পড়ে তার বন্ধুদের মাঝেও। ক্লাসের ফাষ্টবয় আসাদ থেকে শুরু করে আবুল, নুরুজ্জামান,মোস্তফা আরও অন্যন্য বন্ধুরাও বাদ যায়নি।

চারিদিকে এগার দফার আন্দোলনের মিছিলে শ্লোগানে প্রকম্পিত রাজপথ। স্কুলের দন্ড উপেক্ষা করে ইউছুফ সহ অন্যন্যরা বেড়িয়ে পড়ে রাজপথে। এরপর মিছিল শেষে সমাবেশ। সমাবেশে ইউছুফের বক্তব্য শুনে তাদের বন্ধুরা নতুন রুপে আবিস্কার করে। তারা জানতোনা তাদের এমন বন্ধু আছে যে কিনা তাদের আগে দেশকে নিয়ে ভাবে।

এরপর দেশের টানে ঘর ছাড়ে পথে নামে পাঁচ বন্ধু। রাতের আধাঁরে পালিয়ে চলে আসে ঢাকায় ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য। সেদিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষন শোনে তাদের মধ্যে খেলে যায় অন্যরকম রক্তস্রোত। ক্লাশের ফার্স্টবয় আসাদের মনে এই বোধ জাগ্রত হয়ে যে দেশ যদি না থাকে পড়াশোনা দিয়ে কি হবে? এভাবেই ঘর ছেড়ে পথে নামা এরপর আর ঘরে ফেরা হয়নি। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে এলোপাতাড়ি গুলি আর মর্টার সেলের শব্দে সারারাতে পার করে চরম আতন্কে। এরপর ভোর বেলায় রক্তের বন্যা আর লাশের পাহাড় ঠেলে পালিয়ে চলে যায় নিমতলী ঘাট হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপার। সাথে যোগ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুভাষ ও নিমতলীর আরো কয়েকজন।

অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে একসময় পৌঁছে যায় সুন্দরবন। সেখানে আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন হচ্ছিল । পাঁচ বন্ধু প্রশিক্ষন নিতে শুরু করে। আর এই প্রশিক্ষন শেষে তারা হয়ে উঠে গেরিলা বাহিনী। ক্রমে ক্রমে পাচঁ কিশোরের গেরিলা বাহিনী সফলতার সাথে অভিযান চালাতে থাকে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী বিরুদ্ধে। এরপর একদিন লাল সবুজের পতাকা নিয়ে তবেই ফিরে আসে সেই দুরন্ত কিশোরের দল। আমাদের স্বাধীন দেশের রত্ন পাঁচ গেরিলা। সেদিন হাজার হাজার জনতা ফুলের মালায় বরণ করে নেয় তাদের।

এতক্ষন গেরিলাদের আমার মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের যে গল্পটি বলেছি তা হলো নাসির আহমেদ কাবুলের লেখা কিশোর উপন্যাস “পাঁচ গেরিলার মুক্তিযুদ্ধ।“ বইটি প্রকাশিত হয়েছে একুশে বইমেলা ২০১৫তে। বইটি প্রচ্ছদ করেছেন দেশের খ্যতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী সোঁহাগ পারভেজ। জলছবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “পাঁচ গেরিলার মুক্তিযুদ্ধ” উপন্যাসটির মুল্য ধরা হয়েছে ১২০ টাকা। পরিবেশনায় আছেন দেশের নামকরা প্রকাশনী ম্যগনাম ওপাশ। যাদের ১১২ আজিজ সুপার মার্কেটে শো রুম রয়েছে।

লেখক সম্পর্কে দুচার কথা বলে নিতে হয়। বাংলাদেশ বেতার তালিকা ভুক্ত গীতিকার নাসির আহমেদ কাবুল এর সাথে আমার পরিচয় কবিতার মাধ্যমে। তার লেখা কবিতা ও কবিতার প্রতি একনিষ্ঠতায় আমি মুগ্ধ। বয়স বিবেচনায় না আনলে তিনি তরুন প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হতে পারেন যারা শুরুতেই কিছু হচ্ছেনা বলে পিছিয়ে যেতে চান। যারা একলা হাটেন নাসির আহমেদ কাবুল তাদের একজন। তার লেখা উপন্যাসের সাথে এটাই আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম হিসেবে তিনি আমাকে হতাশ করেননি। যদিও এটা তার দ্বিতীয় কিশোরদের জন্য লেখা। বড়দের জন্য কবিতা লিখলেও তিনি শিশু কিশোর জন্য গদ্য লিখছেন। সেই হিসেবে কিশোর উপন্যাস পাঁচ গেরিলার মুক্তিযুদ্ধ বইটি কিশোরদের জন্য একটা সংযুক্তি বলা যেতে পারে।

এবার উপন্যাস সম্পর্কিত কিছু কথা। আমার কাছে মনে হয়েছে বড়দের জন্য কবিতা লিখতে গিয়ে উপন্যসেও সেই বড় ছাপটা রয়ে গেছে। বলতে গেলে কিশোর উপন্যাস বলতে যা বুঝায় ঠিক কেন্দ্রে এই উপন্যাসটিকে ফেলা যাবেনা। বলতে হবে কিশোর উত্তীর্ণ। কেননা কিশোরদের জন্য যে ধরনের বয়ান করতে হয় আমি পাঠক হিসেবে আমার সময় বা তার আগের আমেজ পেয়েছি। কিশোরদের জন্য বয়ান আমি পাইনি। পুরো উপন্যাসে পাঁচ জন কিশোরকে গেরিলা হিসেবে পেয়েছি এর বাইরে পুরো উপন্যাসের কিশোর তেমন কোন ভুমিকা ছিলনা।

একথা অনস্বীকার্য যে মুক্তিযুদ্ধের উপর গল্প প্রবন্ধ এবং উপন্যাস লেখা খুবই কঠিন কাজ। এতে ইতিহাস নির্ভর গল্প লিখে যেতে হয়। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে তার নিরিখে সঠিক তথ্য উপস্থাপন বাধ্যতামুলক হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একেকটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প মানেই একেকটি ইতিহাস বা ইতিহাসের খন্ডচিত্র। যা একজন লেখকের পক্ষে বেশ কঠিন। আলোচিত লেখক নাসির আহমেদ কাবুল সেই কঠিন কাজটিতেই হাত দিয়েছেন। তাও কিশোরদের জন্য।

উপন্যাসটি শুরু হয়েছে এগার দফা আন্দোলনের সময় ও মঠবাড়িয়ার প্রেক্ষাপটকে নিয়ে। এবং শেষ হয় ডিসেম্বর এর বিজয়ের মধ্য দিয়ে। লেখক মুলত গল্পচ্ছলে কিশোরদের একটি দলের দেশের টানে বাড়ী থেকে পালানো এবং যুদ্ধে যোগদানের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বর্ণনা করেছেন কিভাবে গেরিলা আক্রমন চালাতে হয় তারও। তবে আমি উপন্যাসটি পড়ার সময় নাম দেখে মনে করেছিলাম পুরো উপন্যাস জুড়ে শুধু গেরিলা সংক্রান্ত আলোচনা বর্ণনা এবং এবং একাধিক গেরিলা যুদ্ধে পাঁচ কিশোরের জীবন বাজী রাখার টান টান উত্তেজনা পুর্ন ঘটনাবলী পাবো। কিন্তু আমি এখানটায় বঞ্চিত হয়েছি। গেরিলাদের গেরিলা হয়ে উঠার ঘটনা বয়ান করতে উপন্যাসের সিংহভাগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এইটুকু বাদ দিরে গেরিলাদের যুদ্ধে যোগদান থেকে শুরু করে বাকী সকল ঘটনা বেশ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর পুরো ভাষনটি তিনি উপন্যাসে তুলে দিয়েছেন। বিশেষ করে কিশোরদের কথা চিন্তা করেই হয়ত এই কাজটি তিনি করেছেন। তবে যদি আরো কিশোর সুলভ করা হতো, যুদ্ধের বর্ণনা গুলোকে আরো বেশী সন্নিবে করতে পারলে আরো ভাল হতো।

একটা গল্প বা উপন্যাস সর্বোপরি কেমন তা এক বাক্যে বলা মুশকিল। তবুও প্রচেষ্টাকে আমি সফল মনে করছি। লেখা সম্পাদনা এবং শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে উপন্যাসে বেশ সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সবশেষে লেখকের কাছে আরো বেশী করে কিশোরদের উপযোগী লেখা আশা করছি।

লুৎফর পাশা

মন্তব্য করুন