ছন্দ ও শুদ্ধ বানা চর্চা- দ্বিতীয় পর্ব

ছন্দ ও শুদ্ধ বানা চর্চা -দ্বিতীয় পর্ব

তৎসম শব্দ চেনার কৌশল

১। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মানুযায়ী ‘ঈ ঊ ঋ এবং এ তিনটি বর্ণের কারচিহ্ন দীর্ঘ ই-কার, দীর্ঘ উ-কার এবং ঋকার ( ী- ূ- ৃ’) যুক্ত সব শব্দই তৎসম শব্দ।২। মূর্ধন্য-ণ যুক্ত সব শব্দ তৎসম।৩। যেসব শব্দের পূর্বে প্র, পরা, অপ, সম, অব, অনু, নির(নিঃ), দুর(দুঃ), উৎ, অধি, পরি, প্রতি, উপ, অভি, অতি প্রভৃতি উপসর্গ যুক্ত থাকে সেগুলো তৎসম শব্দ হবে।৪। ক্ত্র, ক্ম, ক্ষ, ক্ষ্ণ, ক্ষ্য, ক্ষ্ম, ক্ষ্ম্য, গ্ধ, গ্ন্য, গ্ম, ঘ্ন, ক্সক্ষ, ক্সম, চ্ছ্ব, চ্ছ্র, জ্ঝ, জ্ঞ, ঞ্ছ, ঢ্র, ত্ত্ব, ত্ম্য, ত্র্য, দ্ব্য, দ্ম, ধœ, ধ্ম, ন্ত্য, ন্ত, ন্ত্র, ন্ত্র্য, ন্দ্ব, ন্ধ্য, ন্ধ্র, ন্ন্য, ল্ম, শ্ছ, শ্ম, ষ্ক্র ষ্ট্র, ষ্ট্য, ষ্ট্র, ষ্ব, ষ্ম, স্ত্য, স্থ্য, হ্ন্য, হ্ম, হ্ল ইত্যাদি যুক্তবর্ণ কেবল তৎসম শব্দে দেখা যায়। অতএব এমন যুক্তবর্ণ-যুক্ত শব্দ তৎসম।৫। বিসর্গযুক্ত শব্দগুলো এবং বিসর্গসন্ধিসাধিত শব্দগুলো তৎসম শব্দ।৬। বহুবচনবাচক গণ, বৃন্দ, ম-লী, বর্গ, আবলি, গুচ্ছ, দাম, নিকর, পুঞ্জ, মালা, রাজি, রাশি প্রভৃতি থাকলে শব্দ তৎসম হয়।৭। সমাসবদ্ধ পদের একটি অংশ তৎসম জানা থাকলে অপর অংশটি এবং সমস্তপদটিও তৎসম হয়। যেমন চন্দ্রমুখ শব্দে চন্দ্র অংশটি তৎসম জানা থাকলে বলা যায় ‘মুখ’ এবং ‘চন্দ্রমুখ’ শব্দদ্বয়ও তৎসম।৮। উপমান কর্মধারয়, উপমিত কর্মধারয় এবং রূপক কর্মধারয় সমাস দ্বারা সাধিত শব্দগুলো সাধারণত তৎসম হয়।৯। অব্যয়ীভাব এবং প্রাদি সমাস দ্বারা সাধিত পদগুলো সাধারণত তৎসম হয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে।১০। শব্দের শেষে -তব্য এবং -অনীয় থাকলে সেসব শব্দ তৎসম হয়। যেমন : কর্তব্য, দ্রষ্টব্য, ভবিতব্য, করণীয়, দর্শনীয় প্রভৃতি তৎসম।১১। শব্দের শেষে তা, ত্ব, তর, তম, বান, মান, এয়, র্য প্রভৃতি থাকলে সাধারণত শব্দগুলো তৎসম হয়।১২। অব্যয়পদের শেষে ত থাকলে তা সাধারণ তৎসম হয়। যেমন : প্রথমত, অন্তত, জ্ঞানত। তবে এ নিয়মের আওতায় পড়ে না, এমন বহু তৎসম শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়। সেসব শব্দগুলো আয়ত্তে আনার জন্য চর্চা প্রয়োজন।সহজে অতৎসম শব্দ চেনার উপায়১। ষ যুক্ত অধিকাংশ শব্দ তৎসম, কিন্তু সকল শব্দ তৎসম নয়। যেমন পোষা, ষোলো, বোষ্টম প্রভৃতি তৎসম নয়।২। চন্দ্রবিন্দুযুক্ত কোন শব্দই তৎসম নয়।

অর্ধতৎসম শব্দ

যেসব শব্দ সংস্কৃতভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলাভাষায় এসেছে সেগুলোকে অর্ধতৎসম শব্দ বলে। যেমন : গতর (গাত্র), কেষ্ট (কৃষ্ণ), গিন্নি (গৃহিণী), সূর্য (সূর্য্য)ি, বৃষ্টি (বিষ্টি), ক্ষুধা (খিদে), জ্যোৎ¯œা (জোছনা), শ্রী (ছিরি), গ্রাম (গেরাম), নিমন্ত্রণ (নেমন্তন্ন), শ্রাদ্ধ (ছেরাদ্দ) ঘৃণা (ঘেন্না), কর্ণ (কান), স্বর্ণ (সোনা)।

তদ্ভব শব্দ

যেসব শব্দ সংস্কৃতভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃতভাষার মধ্যদিয়ে বাংলাভাষায় এসেছে সেগুলোকে তদ্ভব শব্দ বলে।সকল অতৎসম অর্ধাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং কারচিহ্ন (ি ু ) ব্যবহৃত হবে। যেমন : আরবি, আসামি, ইংরেজি, ইমান, ইরানি, উনিশ, ওকালতি, কাহিনি, কেরামতি, খুশি, খেয়ালি, গাড়ি, গোয়ালিনি, চাচি, জমিদারি, জাপানি, জার্মানি, টুপি, তরকারি, দাড়ি, দাদি, দাবি, দিঘি, দিদি, নানি, নিচু, পশমি, পাখি, পাগলামি, পাগলি, পিসি, ফরাসি, ফরিয়াদি, ফারসি, ফিরিঙ্গি, বর্ণালি, বাঁশি, বাঙালি, বাড়ি, বিবি, বুড়ি, বেআইনি, বেশি, বোমাবাজি, ভারি (অত্যন্ত অর্থে), মামি, মালি, মাসি, মাস্টারি, রানি, রুপালি, রেশমি, শাড়ি, সরকারি, সিন্ধি, সোনালি, হাতি, হিজরি, হিন্দি, হেঁয়ালি।চুন, পুজো, পুবচ, মুলা, মুলো।পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন : ছেলেটি, বইটি, লোকটি।সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ ও যোজক পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : এটা কী বই? কী আনন্দ! কী আর বলব? কী করছ? কী করে যাব? কী খেলে? কী জানি? কী দুরাশা! তোমার কী! কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে! কী পড়ো? কী যে করি! কী বাংলা কী ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী।কীভাবে, কীরকম, কীরূপে প্রভৃতি শব্দেও ঈ-কার হবে।যেসব প্রশ্নবোধক বাক্যের উত্তর হ্যাঁ বা না হবে, সেইসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : তুমি কি যাবে? সে কি এসেছিল?এ, অ্যাবিদেশী শব্দে ক্ষেত্র-অনুযায়ী অ্যা বা ্যা-কার ব্যবহৃত হয়।যেমন : অ্যাকাউন্ট, অ্যান্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাংক, ভ্যাট, ম্যানেজার, হ্যাট।বাংলা অ-ধ্বনির উচ্চারণ বহু ক্ষেত্রে ও-র মতো হয়। শব্দশেষের এসব অ-ধ্বনি ও-কার দিয়ে লেখা যেতে পারে।যেমন : কালো, খাটো, ছোটো, ভালো।এগারো, বারো, তেরো, পনেরো, ষোলো, সতেরো, আঠারো।কারানো, খাওয়ানো, চড়ানো, চালানো, দেখানো, নামানো, পাঠানো, বসানো, শেখানো, শোনানো, হাসানো।কুড়ানো, নিকানো, বাঁকানো, বাঁধানো, ঘোরালো, জোরালো, ধারালো, প্যাঁচানো।করো, চড়ো, জেনো, ধরো, পড়ো, বলো, বসো, শেখো, করাতো, কেনো, দেবো, হতো, হবো, হলো।কোনো, মতো।ং ঙশব্দের শেষে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে। যেমন :গাং, ঢং, পালং, রং, সং।তবে অনুস্বারের সঙ্গে স্বর যুক্ত হলে ঙ হবে । যেমন :বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের।তবে বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দে অনুস্বার থাকবে।ক্ষ, খঅতৎসম শব্দ খিদে, খুদ, খুদে, খুর (গবাদি পশুর পায়ের শেষ প্রান্ত), খেত, খ্যাপা ইত্যাদি লেখা হবে।জ, যবাংলায় প্রচলিত বিদেশি শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন :কাগজ, জাদু, জাহাজ, জুলুম, জেব্রা, বাজার, হাজার।ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত কয়েকটি শব্দে বিকল্পে য লেখা যেতে পারে। যেমন :আযান, ওযু, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান, হযরত।মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য নঅতৎসম শব্দের বানানে ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন :অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গভর্নর, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, রানি, সোনা, হর্ন।তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে যুক্ত নাসিক্যবর্ণ ণ হয়। যেমন :কণ্টক, প্রচ-, লুণ্ঠন।কিন্তু অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগে কেবল ন হবে। যেমন :গুন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা, ডান্ডা, লন্ঠন।শ ষ সবিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। যেমন : কিশমিশ, নাশতা, পোশাক, বেহেশত, শখ, শয়তান, শরবত, শরম, শহর, শামিয়ানা, শার্ট, শৌখিন।আপস, জিনিস, মসলা, সন, সাদা, সাল (বৎসর), স্মার্ট, হিসাব।স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্ট্রিট, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর।ইসলাম, তসলিম, মুসলমান, মুসলিম, সালাত, সালাম,এশা, শাওয়াল (হিজরি মাস), শাবান (হিজরি মাস)।ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি S এবং sh, sion, -ssion, -tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে। যেমন :পাসপোর্ট, বাসক্যাশটেলিভিশনমিশন, সেশনরেশন, স্টেনশ।যেখানে বাংলায় বিদেশি শব্দের বানান পরিবর্তিত হয়ে স ছ-এর রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ-এর ব্যবহার থাকবে। যেমন : তছনছ, পছন্দ, মিছরি, মিছিল।বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণবাংলায় বিদেশি শব্দের আদিতে বর্ণবিশ্লেষন সম্ভব নয়। এগুলো যুক্তবর্ণ দিয়েলিখতে হবে। যেমন :স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং।তবে অন্য ক্ষেত্রে বিশ্লেষ করা যায়। যেমন :মার্কস, শেকসপিয়র, ইসরাফিল।হস চিহ্নহস-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন :কলকল, করলেন, কাত, চট, চেক, জজ, ঝরঝর, টক, টন, টাক, ড্যিশ, তছনছ, ফটফট, বললেন, শখ, হুক।তবে যদি অর্থবিভ্রান্তি বা ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে, তাহলে হস-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : উহ্, বাহ্, যাহ॥ঊর্ধ্ব কমাঊর্ধ্ব কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে।

চলবে

#ছন্দ_শুদ্ধ_বানান_চর্চা_২

মন্তব্য করুন