মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া

রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। ১৮৮০ সাল। নারীরা আজও জন্ম নেয় আবার তখনও জন্ম গ্রহণ করেছে। পার্থক্যটা বিশাল। আজ নারীরা ঘরের কাজ আর বাইরের কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারছে। মাতৃ দায়িত্ব থেকে শুরু করে মহাকাশে কাজ করে চলেছে। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যখন অপসংস্কৃতির আর নারী বিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে নারীরা বন্দী ছিল তখন বেগম রোকেয়া জন্ম গ্রহণ করেন। সমাজের কাঠামো এমন স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছিল যেখানে নারীদের কঠোর নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করতে হতো। জ্ঞান তৃষ্ণা পূরণ করাও তখন বেশ দূরহ ছিল। বেগম রোকেয়াকে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়। কেন তাকে অগ্রদূত বলা হয় তা তার জীবন আলোচনা থেকেই বোঝা যায়। তিনি যে সময় জন্ম গ্রহণ করেন সে সময় ইংরেজী শিক্ষা তো বহুদুরের কথা মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণই ছিল নিষেধ। মেয়েদের কাজ ছিল সন্তান জন্মদান, লালনপালন ও গৃহ কাজকর্মের মধ্যে সিমাবদ্ধ। এমনকি নিজ পরিবারেও মতামত প্রকাশ করা ছিল কঠিন কাজ। বাইরের জগতে বের হওয়ার সুযোগও ছিল খুব কম। বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি আবিষ্কার করলেন বাইরের পৃথিবীটা তার জন্য নয়। সেটা শুধুই পুরুষদের দখলে। তাকে ঘরেই আরবী ও উর্দু শিক্ষা দেওয়া হলো। তবে জ্ঞানের নেশা যাকে পেয়ে বসে তাকে থামানো যায় না। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম ছিলেন আধুনিক মনস্ক। তিনিই বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। তবে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্তরালে।
নিজ পরিবারেই একাধারে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী থাকলেও বড় ভাইয়ের মত আধুনিক মনস্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। যা পরবর্তীকালে তার জ্ঞান তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার জন্য এমন ধ্যান ছিল বলেই তিনি নিজে জাগতে পেরেছেন হতে পেরেছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত। নিজেকে জাগানোই যেখানে বেশ কঠিন কাজ সেখানে অন্যকে জাগিয়ে তোলার কাজটিও তিনি দক্ষ হাতেই করেছেন। তার হাত ধরেই নারী অধিকার আদায়ে পরবর্তীতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তবে শুধু নারী জাগরণের অগ্রদূত বললে বেগম রোকেয়ার ভূমিকাকে সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না বলেই আমার মনে হয়। কারণ যে পরিবেশের মধ্যে থেকে তিনি ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করেছেন তাও বিবেচনায় আনতে হবে। যদিও তার অধিকাংশই নারী অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে কিন’ পড়ার প্রতি যে তীব্র ঝোঁক তাও শেখায়। আবার পুরুষ জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কাজটিও ভালভাবেই করেছিলেন তিনি। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য সাধনা প্রসারিত হয় বা সামনে আসার সুযোগ করার পিছনে যে ব্যাক্তির ভূমিকা রয়েছে তিনি বেগম রোকেয়ার স্বামী।
১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। বেগম রোকেয়ার সাথে স্বামীর সাখাওয়াত হোসেন যুক্ত হয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামেই পরবর্তীতে পরিচিত হন। নিজের বাড়িতে বেগম রোকেয়ার বড় ভাইয়ের সাহচর্যে জ্ঞান শিক্ষা লাভ করার পর স্বামীর সাহচর্যে তিনি সাহিত্য চর্চার পূর্ণ সুযোগ পান। কারণ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। তিনি শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে সাহিত্য চর্চার উদার পরিবেশ সৃষ্টি করেই বসে ছিলেন না , একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদাও করে রাখেন। এতে তার বিদ্যা মনস্ক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। যে পরিবেশ বেগম রোকয়ার পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেও ভূমিকা রেখেছিল। আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়।
সুলতানার স্বপ্ন বেগম রোকেয়ার এক অনন্য সৃষ্টি। নারীবাদি সাহিত্যে, নারী চেতনার জাগরণে এটি অন্যতম রচনা। এছাড়াও অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, মতিচূর ইত্যাদি গ্রন্থেও তিনি তার চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিপুনভাবে।

অ.আ প্রকাশকাল: 10:52 PM

কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য