লিও তলস্তয় : রুশ কথাসাহিত্যিক

তলস্তয় : রুশ কথাসাহিত্যিক
(২৮শে আগস্ট, ১৮২৮ — ২০শে নভেম্বর, ১৯১০) জন্ম ও জন্মস্থান : লেভ নিকোলেয়েভিচ তলস্তয় (Lev Nikolayevich Tolstoy), যিনি লিও তলস্তয় (Lio Tolstoy) নামে সুপরিচিত, তাঁর জন্ম ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার টুলা রাজ্যে।

জাতীয়তা : রাশিয়ান।

পেশা : ঔপন্যাসিক, ছোটো ও বড়োগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, ডায়েরী রচয়িতা ও সৈনিক।

পারিবারিক পরিচয় : তিনি চার ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম। তলস্তয়ের শৈশবেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয় এবং তলস্তয়ের বাবার এক জ্ঞাতি ভাই তাঁর দেখভাল করতে থাকেন। সাত বছর বাদে তাঁর বাবার মৃত্যু হয় এবং তাঁদের এক পিসি তাঁদের অভিভাবক হন।

দাম্পত্য জীবন : ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে লিও তলস্তয় সোফিয়া নামের এক চিকিৎসকের কন্যাকে বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর, সোফিয়ার ১৮ বছর। এই দম্পতির ১৪ জন সন্তান।

শিক্ষা জীবন : লিও তলস্তয় তাঁর বাড়িতেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যদেশীয় ভাষার এক শিক্ষাক্রমে তিনি যোগ দেন। কিন্তু ছাত্র হিসেবে কৃতী হয়ে উঠতে তিনি ব্যর্থ হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যাগ করেন এবং কৃষক হওয়ার জন্য তাঁর বাবার জমিদারিতে ফিরে আসেন। তিনি নিজের চেষ্টায় আরো অনেক ভাষা শিখেছিলেন। যেমন – লাতিন, ইংরেজি, আরবি, তুর্কো-তাতার, ইতালিয়ান, গ্রিক এবং হিব্রু। সঙ্গীতশাস্ত্র এবং চিত্রাঙ্কন বিদ্যাতেও মোটামুটি পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর একাগ্রতা ও পরিশ্রম করার শক্তি ছিল অসাধারণ, তিনি মেধাবীও ছিলেন। বস্তুত তিনি সশিক্ষিত ছিলেন।

সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ : শীঘ্রই লিও তলস্তয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিখ্যাত ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন (১৮৫৩-১৮৫৬)।

প্রথম প্রকাশিত গল্প : যোদ্ধা হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তিনি একটি আত্মজীবনী মূলক গল্প লেখেন, যার নাম ‘Childhood’। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গল্পটি সেই সময়ের সবথেকে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘The Contemporary’-তে জমা দেন। এই পত্রিকায় গল্পটি গৃহীত হয় এবং এটি হয়ে ওঠে তলস্তয়ের প্রথম প্রকাশিত গল্প।

সাহিত্যকর্ম : লিও তলস্তয়ের রচনার পরিমাণ ছিল বিশাল। উপন্যাস, ছোটোগল্প, বড়োগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, ডায়েরী, চিঠিপত্র সব মিলিয়ে তাঁর রচনা সমগ্র প্রায় ৯০টি খণ্ডে বিভক্ত।

আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ : ১) ‘Childhood’ [‘চাইল্ডহুড’] (গল্প : ১৮৫২)
২) ‘Boyhood’ [‘বয়হুড’]
৩) ‘Youth’ [‘ইউথ’] (১৮৫২-১৮৫৬)
৪) ‘পুনরুত্থান’ (উপন্যাস : ১৮৯৯)

আত্মজীবনী মূলক ত্রয়ী (ট্রিলজী) : লিও তলস্তয়ের ত্রয়ীর প্রথম গ্রন্থ হল ‘Childhood’ (১৮৫২) গল্প। তিনি অপর দুটি গ্রন্থ ‘Boyhood’ এবং ‘Youth’ (১৮৫২-১৮৫৬) শীর্ষক তাঁর আত্মজীবনী মূলক ট্রিলজীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন।

দুটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস :
লিও তলস্তয়ের অনেক রচনাই নিঃসন্দেহে বিশ্বসাহিত্যে কালজয়ী সৃষ্টি। ‘War and Peace’ (১৮৬২-১৮৬৯) নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম। ব্যপ্তি এবং চমৎকারিত্বের দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে একটি মহাকাব্য। তাঁর আর একটি কালজয়ী সৃষ্টি হল ‘Anna Karenina’ (১৮৭৩-১৮৭৭) উপন্যাস।

গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস :
১) ‘War and Peace’ [‘যুদ্ধ ও শান্তি’] (১৮৬২-১৮৬৯)
২) ‘Anna Karenina’ [‘আন্না কারেনিনা’] (১৮৭৩-১৮৭৭)
৩) ‘Family Happiness’ [‘পরিবারের সুখ’]
৪) ‘Hadji Murad’ [‘হাদজি মুরাদ’]
৫) ‘রেজারেকশন’
৬) ‘পুনরুত্থান’ (১৮৯৯)

ছোটোগল্প :
১) ‘পিঁপড়ে ও পায়রা’
২) ‘পিঁপড়ে আর পায়রা’
৩) ‘শিশু কাহিনি’
৪) ‘ককেশাসের বন্দি’
৫) ‘ইলিয়াস’ (১৮৮৫)

বড়োগল্প :
১) ‘The Death of Ivan Ilych’ [‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’] (১৮৮৬)
২) ‘Father Siyergi’ [‘ফাদার সিয়ের্গি’] (১৮৯৮)

গল্প সংকলন :
১) ‘Twenty Three Tales’

নাটক :
১) ‘অন্ধকারের শক্তি’ (১৮৮৭)
২) ‘জিন্দা লাশ’ (১৯০০)

‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ (১৮৬২-১৮৬৯) উপন্যাস :
উনিশ শতকের ছয়ের দশকের শুরু থেকে লিও তলস্তয় তাঁর উপন্যাস ‘War and Peace’ নিয়ে মেহনত করতে শুরু করেন। উপন্যাসটি তিনি ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে লেখা শুরু করেন এবং ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে শেষ করেন। পাঠক ও সমালোচক উভয়েই এটি পড়ে অভিভূত হয়ে যান। এটিতে নেপোলিয়নের যুদ্ধের ঐতিহাসিক বর্ণনার সঙ্গে বাস্তবধর্মী অথচ কল্পনাশ্রয়ী কিছু চরিত্রের সুচিন্তিত ক্রমবিবর্তন যুক্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এর মতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হচ্ছে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। দস্তয়ভস্কি লিও তলস্তয়কে জীবিত সকল লেখকদের ভিতর শ্রেষ্ঠ ভাবতেন। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ পাঠ করে ফ্লবেয়ার মস্তব্য করেছিলেন, “কী মহান শিল্পী, কী অসামান্য মনস্তত্ত্বিক!” ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-কে বলা যায় দানব আকৃতির উপন্যাস । এতে প্রধান চরিত্রই আছে ৫৮০টি, যারা চারটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। বংশানুক্রমিক ও জটিল উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে ইতিহাস, নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের ঘটনা।

‘আন্না কারেনিনা’ (১৮৭৩-১৮৭৭) উপন্যাস :
‘War and Peace’-এর পরেই লিও তলস্তয় ‘Anna Karenina’ ১৮৭৩-১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। এতে লিও তলস্তয়ের জীবনের কিছু ঘটনাকে কল্পনাশ্রয়ীভাবে দেখানো হয়েছে, বিশেষত কিটি ও লেভিনের মধ্যে প্রেম পর্বটি যেটিকে বলা হয়ে থাকে যে তলস্তয় ও তাঁর স্ত্রীর প্রেম পর্বের অনুরূপ। ইতিমধ্যে তলস্তয় বেশ বিখ্যাত ও ধনী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর উপন্যাসগুলি থেকে অর্জিত রয়ালিটির কারণে।

নবম শ্রেণির পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত গল্প :
নবম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’-তে লিও তলস্তয়ের ‘ইলিয়াস’ (১৮৮৫) নামক গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই গল্পটি নেওয়া হয়েছে তাঁর ‘Twenty Three Tales’ গল্প সংকলন থেকে। গল্পটির তর্জমা করেছেন অধ্যাপক মণীন্দ্র দত্ত।

পরবর্তী সময়ের সফল সাহিত্যকর্ম :
লিও তলস্তয়ের পরবর্তী সময়ের সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘The Death of Ivan Ilych’ (১৮৮৬) এবং ‘Father Sergius’ (১৮৯৮) যথেষ্ট সফল হয়। তিনি প্রচুর ছোটোগল্প, নাটক এবং প্রবন্ধও রচনা করেন।

তাঁর দ্বারা প্রভাবিত সমাজ নেতৃবর্গ :
লিও তলস্তয় এক আধ্যাত্মিক সংকট ভোগ করেছিলেন এবং রাশিয়ার রক্ষণশীল চার্চ কর্তৃক বিতাড়িত হন। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভূত প্রশংসা লাভ করেছিলেন। তাঁর অহিংস প্রতিরোধের ধ্যানধারণা মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং- জুনিয়র – এর মতো সমাজ-নেতৃবর্গকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেন।

তাঁর বিখ্যাত হওয়ার কারণ :
লিও তলস্তয় বিখ্যাত হন কারণ তাঁর সাহিত্য বাস্তবতার সঙ্গে মানুষের অবস্থা উন্মোচিত করেছিল। তিনি যে সমাজে বাস করতেন তাঁর লেখায় সেই সমাজ প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কথাসাহিত্য রচনার জন্যই স্মরণীয়। খ্রিস্টীয় দর্শনের প্রসারের জন্যও তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর দর্শন মানুষের জীবন ও সুখ সম্পর্কিত নতুন ভাবনা গঠনের সহায়ক হয়েছে। তিনি কঠোর নীতিবাদী ছিলেন এবং তিনি সেগুলিকে যুক্তিসঙ্গত ও প্রত্যয়জনকভাবে তাঁর উপন্যাস সমূহে এবং ছোটোগল্পে তন্নতন্ন করে খতিয়ে দেখেছিলেন।

তাঁর জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ :
লিও তলস্তয়ের জীবনের ঘটনাবহুল শেষ বছরটি নিয়ে গতবছর ‘দ্য লাস্ট স্টেশন’ (‘The Last Station’) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি :
১) “মানুষের সুখ আর পরিশ্রম তার জীবন গড়ে তোলে।”
২) “একমাত্র প্রেমেই বিয়েকে পবিত্র করতে পারে। আর একমাত্র অকৃত্রিম বিয়ে হচ্ছে সেটাই, যেটা প্রেমের দ্বন্দ্ব।”

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি :
১) ক্রিমিয়ার যুদ্ধে থাকার সময় লিও তলস্তয় তাঁর লেখা চালিয়ে যান। যুদ্ধের পরে পর তলস্তয় সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং রাশিয়ায় ফিরে আসেন।

২) ২০০৭ সালে পরিচালিত এক জরীপ অনুযায়ী সর্বকালের সেরা দশটি উপন্যাসের তালিকায় ‘আন্না কারেনিনা’ (১৮৭৩-১৮৭৭) প্রথম এবং ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ (১৮৬২-১৮৬৯) তৃতীয় হয়, অর্থাৎ সেরা দশের দুটিই লিও তলস্তয়ের রচনা, তাও শীর্ষের। তলস্তয় কোন মাপের ঔপন্যাসিক তা বোঝাতে এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।

৩) ধর্ম-সর্স্পকিত তাঁর ধারণাসমূহ খ্রিস্টিয় মতাদর্শ আশ্রয়ী হলেও তাতে বৌদ্ধধর্মের চেতনাই বেশি প্রতিফলিত। পুঁজিবাদ ও শোষণ বিরোধী সংগ্রামে তিনি অহিংস প্রতিবাদের কথা বলেছেন। এ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রবর্তক মহাত্মা গান্ধী ও আমেরিকার কালো মানুষদের নেতা মার্টিন লুথার কিং-জুনিয়র। লিও তলস্তয়কে মহাত্মা গান্ধী অহিংস আন্দেলনের সবচেয়ে ‘বড় গুরু’ বলে স্বীকার করেছিলেন। আশ্চর্য নয় যে, দক্ষিন আফ্রিকায় গান্ধীজির আশ্রমটির নাম ছিল ‘তলস্তয় কলোনি’।

৪) একেবারেই সাদাসিধে জীবন যাপনে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। পিতার জমি যখন তার ভাইদের মধ্যে ভাগ করা হয় তখন তিনি সব থেকে অনুরবর অংশটি নিয়েছিলেন। এমনকি মৃত্যুর পর তাঁকে যেন সবচেয়ে সস্তা কফিনে সমাহিত করা হয়, নিকটজনদের তা বলে গিয়েছিলেন। রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণির দায়িত্বজ্ঞানহীন, ইন্দ্রিয়পরায়ন জীবনচর্চ্চায় তাঁর বিবমিষা জাগে, তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন আর তা থেকে মুক্তি পেতে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে।

৫) লিও তলস্তয়ের জীবনের ঘটনাকে অবলম্বন করে অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। আজও তাঁর লেখাগুলি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা (অ্যাওয়ার্ড) :-
১) ‘যোকোভিচ অ্যাওয়ার্ড’ (রাশিয়া)
২) ‘বোসনিকা অ্যাওয়ার্ড’ (রাশিয়া)

শেষজীবন, মৃত্যু ও মৃত্যুস্থান
লিও তলস্তয় শেষ বয়সে প্রায় সন্তের জীবন-যাপন করতে চেয়েছিলেন। নিজের কাজ তিনি নিজে হাতে করতেন, এমন কি জুতো নিজে তৈরি করে পরতেন, চাষা-ভুষোর মত সাধারণ ও অল্প আহার করতেন, পরতেন ক্ষেত মজুরের পোষাক। শেষ বয়সে তিনি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে ঠান্ডা লেগে তাঁর নিউমোনিয়া রোগ হয়। এতেই তিনি মারা গেলেন বাড়ি থেকে দূরে এক রেলস্টেশনে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর রাশিয়ার অষ্টাপোভোতে এবং টুলা রাজ্যে তাঁদের পারিবারিক জমিদারিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

♦তথ্যঋণ :-
উইকিপিডিয়া (Wikipedia) ও
ইন্টারনেট

মন্তব্য করুন