লিপস-দুর্নীতির মহাকাব্য-২/হিফজুর রহমান

[মহাকাব্য-১ এর কাহিনী জানতে আজ আগামীতে দেয়া আগের এপিসোড বা আমার ফেসবুক দেখুন।]
লাহমায়ার ইন্টারন্যাশনাল (লিপস-এর প্যারেন্ট কোম্পানী) কনসালটেন্সি চুক্তি তো পেয়ে গেল। বিস্তর টাকাও বেরিয়ে গেল। তারপর শুরু হল দুর্নীতির আরেক খেলা। তৎকালীন বিএনপি সরকারকে জানান হলো, ৭০ মেগাওয়াটের স্টিম টারবাইন কেনা হবে জার্মানীর সিমেন্স থেকে। এরই জন্যে জার্মানীর সিমেন্সের ডিরেক্টর ফিন্যান্স হানসে এল স্টিম টারবাইন সরবরাহ এবং দর ঠিক করার জন্যে। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু, আসল চক্রান্ত শুরু হলো। এই চক্রান্তে যেমন যোগ দিল লাহমায়ার, লিপস, একটি জার্মান দাতা সংস্থা। কারণ, তারাই তো ওই থার্ড ফেজের জন্যে অর্থ যোগান দিচ্ছিল। তেমনি যোগ দিল আরইবি এবং আরপিসিএল। আর রেজার (লিপস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এ জেড এম রেজাউল হক) কাজ হলো, সবাইকে নিয়ে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করা। আর দার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মূলত সরকারকে ম্যানেজ করা। এই কাজে সে ব্যবহার করতে লাগল হাওয়া ভবনের ক্ষমতাকে।

চক্রান্তটা ছিল কী? ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলা হল, টারবাইন কেনা হবে জার্মান সিমেন্স থেকে। তাহলে শতমুখ যে হাঁ করে আছে সেই হাঁ বন্ধ করা হবে কী করে? সেজন্যেও তো অনেক টাকা দরকার। সেই টাকা আসবে কোত্থেকে! এর জন্যেই দরকার হয়ে পড়ল চক্রান্ত। সেটা কী? জার্মাান সিমেন্স থেকে টারবাইন কেনা হবে বলা হলেও আসলে ভেতরে-ভেতরে টারবাইন কেনার ব্যবস্থা হল নেদারল্যান্ডের সিমেন্স থেকে। দেশের ভেতরের যাদের নিয়ে এই চক্রান্ত রচনা হলো, তাদের বুঝ দেয়া হলো এই বলে যে, জার্মাান হোক বা নেদারল্যান্ড হোক সিমেন্স তো সিমেন্সই। এই কায়দায় স্টিম
টারবাইনের দাম কমানোর ব্যবস্থা হলো শত হাঁ বন্ধ করার জন্যে। প্রথমেই ভেট নিয়ে এল জামান সিমেন্সের ডিরেক্টর ফিন্যান্স। ভেট ছিল, প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকার মঁ ব্লা ঘড়ি। এই ঘড়িগুলোর দাম ছিল সত্তর হাজার থেকে শুরু করে সম্ভবত দুই লাখ পর্যন্ত। এই ঘড়ি কাদের দেয়া হবে, সেই তালিকা তৈরী হল লিপস-এর সেনা কল্যাণ ভবনের অফিসে, রেজার উপদেশক্রমে। তারপর সেই তাালিকা গেল জার্মানী। তালিকায় মন্ত্রী, সরকারী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, হাওয়া ভবন, আরইবি, ময়মনসিংহ পাওয়ার স্টেশনের মালিক-আরপিসিএল এবং এমন কি আমাদের মত কিছু কর্মকর্তার ভাগ্যেও জুটেছিল ওই ঘড়ির ভেটের ভাগ! অবশ্য আমারটা কোন এক ছিনতাইকারী ভাই নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নেদারল্যান্ডস (ডাচ) সিমেন্সের প্রতিনিধিদল এলেন। তারা ময়মনসিংহ পাওয়ার স্টেশন সফর করে আসার পর ঢাকায় শুরু হল দরকষাকষির পালা। বেশ ক’দিন ধরে মিটিং-এর পর মিটিং। কখনও আরপিসিএল অফিসে আবার কখনও গুলশানের সিমেন্স অফিসে (অবশ্য কেবল ছুটির দিনে) ম্যারাধন সভা চলতে লাগল, লাহমায়ার, সিমেন্স এবং আরপিসিএল মধ্যে।
দীর্ঘ দরকষাকষির পর সকল পক্ষ খুশী মনে সম্মত দরে পৌঁছুলেন। তারপর চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা। ডাচ সিমেন্স এবং আরপিসিএল-এর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হল। তবে, সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের উপ-প্রধান নিকোলাই (পুরো নাম মনে নেই)। তবে, তাঁকে খুব একটা প্রসন্ন বলে কখনও মনে হয়নি আমার। আমার ধারণা, জার্মান সিমেন্সের চাপে পড়েই (ব্যবসার চাপ সব দেশেই সরকারী কর্মকর্তাদের কাবু করে ফেলে) সম্ভবত নিকোলাই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এসেছিলেন জার্মান ফ্লেভার ছড়ানোর জন্যে।
এবার কাজ শুরু হবার পালা। তবে টারবাইন আসার আগে তো সিভিল কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হতে হবে।
গড়ে উঠল স্কাই ইঞ্জিনিয়ারিং
টারবাইন বসানোর জন্যে সিভিল কনস্ট্রাকশনের কাজ ছিল বিশাল। এই কাজও ছিল প্রায় কয়েকশ’ কোটি টাকা। অতি বুদ্ধিমান ও চালাক রেজা এই কাজের লাভ অন্য কাউকে দিতে যাবে কেন? তাই সে স্কাই ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী নামে একটি ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানী খুলে বসল। আর কোম্পানীর দায়িত্ব তো অতি ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত কাউকে দিতে হবে। সেই সঙ্গে অফিসও হবে আলাদা। অস্ট্রেরিয়া দেকে উড়িয়ে আনা হল মেজর মোস্তফা কামাল (অবঃ)-কে। কামাল ভাইয়ের অস্ট্রেলিয়ান ইমিগ্রেশন আমিই করে দিয়েছিলাম উনি সেনাবাহিনী ছাড়ার পর (ওই সময় আমি অস্ট্রেলীয় দূতাবাসে পলিটিক্যাল/ইকনমিক অফিসার হিসেবে কাজ করতাম এবং অফিসে আমার প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। রেজা জানত, ও আসতে বললে কামাল ভাই আসবেন না। কারণ, উনি অস্ট্রেলিয়ায় যাবার আগে রেজার কোম্পানীতে কিছুদিন পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। এখানে একটা কথা বললেই নয়। কামাল ভাই সেনাবাহিনীতে যেমন ভালো অফিসার ছিলেন, তেমনি অত্যন্ত নীতিবানও ছিলেন। তাঁর এই নীতিপরায়ণতার কারণে রেজার অনেক দুষ্কর্মের কথাই তিনি শুনতে চাইতেন না। আবার সেনাবাহিনীতে কামাল ভাই রেজার কয়েক কোর্স সিনিয়র ছিলেন। ফলে দুজনের মতবিরোধ এক পর্যায়ে ঠোকাঠুকির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তাই তিনি এক সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়া। সেই থেকে দুজনের সম্পর্ক খুব একটা মধুরেণ ছিল না।

তাই রেজা কামাল ভাইকে টেনে আনার দায়িত্ব দিওেপর। কারণ আমার প্রতি কামাল ভাই এবং তার পরিবার অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধ পোষণ করতেন। কয়েক দফা ফোনে অনুরোধ করার পর কামাল ভাই আসতে রাজি হলেন, কিন্তু পরিবার তখনই আনতে রাজি হলেন না। যাই হোক কামাল ভাইকে করা হল স্কাই কনস্ট্রাকশনের প্রধান, অনেক দেন-দরবারের পর। স্কাই একটা পৃথক কোম্পানী হলেও সেই কোম্পানীর কোনও একটি সিদ্ধান্তও রেজার ইচ্ছা ছাড়া হত না। স্কাই এর অফিসও বসল সেনা কল্যাণ ভবনের ২১ তলায়। কিন্তু মেজর কামাল প্রায় সারাদিনই নিচে লিপস-এর অফিসে থাকতেন বেশির ভাগ সময় আমার অফিসেই।
তারপর রেজা আরপিসিএলকে রাজি করিয়ে ময়মনসিংহ পাওয়ার স্টেশনের সিভিল কনস্ট্রাকশনের কাজ পাইয়ে দিল স্ক্ইা ইঞ্জিনিয়ারিংকে। স্কাই-এর প্রধান মেজর কামাল হলেও স্কাই সংক্রান্ত সকল মিটিং-এ নেতৃত্ব দিত রেজা। আমাদেরও বাধ্য হয়ে ওই সব মিটিংয়ে থাকতে হত। মেজর কামালকে স্কাই-এর মালিক দেখানো হলেও সবাই জানত এর মলিক রেজা নিজেই।
স্বার্থ যখন শুরু হয়ে যায় সংঘাতও বাড়তে থাকে তার সাথে সাথে। ফলে কামাল ভাই প্রায়ই মনঃক্ষুণœ হয়ে আমাকে বলতেন, ‘হিফজুর ভাই, আপনি না বললে আবার এই অন্যায়ের মধ্যে আসতাম না।’
থার্ড ফেজের কাজের একটা বড় অংশ ছিল মাটি ভরাটের কাজ। প্রায় ২৫ বিঘা নদী ভরাটের কাজ, উচ্চতায়ও অনেক। কেবল মাটি ভরাটেরই কাজের মূল্য ছিল অনেক কোটি টাকা। উচ্চচাপে মাটি ভরাটের কারণে কাজের গুরুত্বও ছিল যথেষ্ট। একটা কথা বলতেই হবে, রেজা কোনও কাজের গুনগত মান রক্ষার ব্যাপারে ছিল অনমনীয়। এজন্যে টাকা খরচও হত বেশি। তবে, ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে সে ওটা পুষিয়ে নিত।
কাজ চলতে লাগল। এর মধ্যে রেজার একগুঁয়েমি এবং লিপস পাওয়ার স্টেশনের শুধুই অপারেশন ও মেইনটেন্যোন্সের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও আরপিসিএলকে এক কোণে ফেলে লিপসকেই পাওয়ার স্টেশনের মালিক হিসেবে দেখাবার চেষ্টার কারণে আরপিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে রেজার সংঘাত দিনের পর দিন বেড়ে চলতে লাগল। একপর্যায়ে রেজা ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মাকসুদুল করিমকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করল। এজন্যেও ঢলের মত টাকা বেরিয়ে যেতে লাগল। এমন কি হাওয়া ভবনের একজনকে একটা পাজেরো গাড়িও উপহার দেয়া হল। আমি লিপস-এর পরিচালক করপোরেট অ্যাফেয়ার্স থাকার কারণে এই সব অপকর্ম আমার হাত দিয়েই হত।
শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত সদাশিব ধরসের মানুষ জনাব করিম বিদায় নিলেন আরপিসিএল থেকে অনেকটাই অপমানিত হয়ে। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, আমি তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করলেও, তাকে আসলে তার নিজেরই কর্মফল ভোগ করতে হয়েছিল। কারণ রেজা নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ¯্রষ্টা ছিলেন তিনিই। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার জনাব আবদুস সবুর। এই কাজটা বাগাতেও রেজার একাউন্ট থেকে অনেকই টাকা বেরিয়ে গেল। এখানে রেজা আরেকটা ভুল করল। কারণ আপাত ভদ্র সবুর ভাই করিম সাহেবের মত দুর্বল মেরুদ-ের মানুষ ছিলেন না। প্রথমে প্রথমে সবুর সাহেব রেজার গুড বুকে থাকলেও, সে সময়টা বেশি দিন টিকল না। কারণ সবুর সাহেব করিম সাহেবের মত ‘জো-হুজুর’ টাইপের মানুষ ছিলেন, নিজে যেটা সঠিক বুঝতেন সেটাই করতেন তিনি। আবার করিম সাহেব যেমন অনেক দিন ধরইে রেজা নির্ভর ছিলেন সবুর সাহেব প্রথম প্রথম কিছুটা ছাড় দিলেও পরে আর তেমনটা ছাড় দিতেন না। ফলে খুব দ্রুতই তাদের ঠোকাঠুকি শুরু হল। রেজা এবার সরিয়ে দিল সবুর সাহেবকে এবং তার দায়িত্ব সাময়িকভাবে দিল আরপিসিএল পরিচালক কারিগরী জহুর সাহেবকে। সবুর সাহেব হাল ছাড়ার লোক নন। তিনি মামলা করে দিলেন তার অপসারণের নির্দেশের বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে রেজার মধ্যে আরপিসিএল দখলের উচ্চাশা জেগে উঠল। এজন্যে সে সাহায্য চাইল হাওয়া ভবনের। কিন্তু হাওয়া ভবনও বা এই্ হালুয়া-রুটির ভাগ নিতে চাইবে না কেন? ফলে হাওয়া ভবনের সাথে রেজার সম্পর্কের অবনতি ঘটা শুরু।
এই পরিস্থিতিতে ভাবলাম, সম্মান থাকতে থাকতে কেটে পড়ি। কার্যকারণ না হয় পরেই বললাম। একদিন মাত্র পাঁচ মিনিটের নোটিশে লিপস-এর বিশাল বেতনে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
এর পরের ঘটনাগুলো রোমহর্ষক।
[আগামীতে আসছে মহাকাব্য-শেষ পর্ব]
হিফজুর রহমান, লেখক, গবেষক এবং উন্নয়ন যোগাযোগ কর্মী

এই ধারাবাহিকগুলো বই আকারে প্রকাশ করবে জলছবি প্রকাশন। আগামী বইমেলায় জলছবির স্টলে পাবেন বইটি।

লিংক : লিপস-দুর্নীতির মহাকাব্য-১ http://ajagami24.com/wp-admin/post.php?

মন্তব্য করুন