লেখার প্রেরণা : লেখকের মনস্তাত্ত্বিক দেয়াল ভাঙার উপায় কী?

মাঈনউদ্দিন মইনুল ll

নতুন লেখকরা সবসময় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখার প্রেরণা সম্পর্কে জানতে চান। লেখার ‘মুড’ কীভাবে আসে? লেখার ‘মুড’ না আসলে আপনি কী করেন? আপনি কি রাইটারস ব্লক বা এরকম কিছু মিথে বিশ্বাস করেন?
একজন খ্যাতিমান লেখককে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি যা উত্তরে জানালেন, তা সকলের জন্য প্রেরণার হতে পারে। আবার বিতর্কের বিষয়ও হতে পারে। উত্তর দেবার আগে তিনি একটি প্রশ্ন জুড়ে দিলেন-

লেখক : সত্য বলবো নাকি মিথ্যা বলবো?
প্রশ্নকারী : অবশ্যই সত্য বলবেন!
লেখক : সত্য বললে আমার ‘লেখক খ্যাতির’ কিছু ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্নকারী : তবু বলুন। লেখকের কাছ থেকেই তো সত্য আশা করা যায়!
লেখক: প্রায় সবগুলো লেখাই ‘আউট-অভ্-মুড’ থাকা অবস্থায় লেখা। ইন ফ্যাক্ট, মুড খারাপ থাকলেই আমি লিখতে বসি!
লেখক নম্বর দুই বললেন, লেখকের আবার ‘মুড’ কী? আমি যদি কথা বলতে পারি, তবে লিখতেও পারি। লেখা তো আসলে আমাদের মুখের কথারই লেখ্য রূপ।
লেখক নম্বর তিন : প্রথমেই আমি যা করি, তা হলো ইন্টারনেট ব্রাউজারগুলো সব বন্ধ করা। এগুলো আমার একনম্বর মনযোগ নষ্টকারী।
লেখক নম্বর চার : আরে কী বলে? ব্রাউজার বন্ধ করলে, লিখবো কী? শুনেন, লেখার মুড না থাকলে প্রথমেই আমি ব্রাউজার খুলে দেই। ফেইসবুকে বন্ধুর স্ট্যাটাস থেকে আমি পাই মহকাব্যের প্রেরণা!

লেখক নম্বর পাঁচ : মুডের অপেক্ষায় থাকলে হবে? সম্পাদকের প্রশ্নের জবাবে যদি বলি ‘মুড নেই’, তবে মাস শেষে বিলটা আসবে কোত্থেকে? আমি লেখা চালিয়ে যাই সকল অবস্থায়। অতএব, মুড না থাকলে প্রথমেই আমি যা করি তা হলো, লেখা শুরু করে দেই।

লেখক নম্বর ছয় : আমি যেখানেই যাই সেখানেই কবিতার/গল্পের বীজ বুনি। ভালো একটি ভাবনা যখন মনে আসে, তখনই আমার নোটবুকে/স্মার্টফোনে সেটি টুকে রাখি। একেকটি ভাবনা, একেকটি কবিতা/গল্প। লিখতে বসলে সেগুলোকেই সম্প্রসারিত করে যাই। কিছু কিছু ভাবনা অবশ্য লিখিত থাকলেও কিছু সময় পর মরে যায়। মানে, লেখার সময় ওগুলোর কোন সূত্র খুঁজে পাই না আর।
লেখক নম্বর সাত : আমি লেখার চাষ করি। সব ফুল যেমন ফল হয় না, তেমনি সব ভাবনায় লেখা হয় না। অর্থাৎ একটি বিষয়ে লেখবো এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি সবসময় বসি না। আমি সাধারণত লিখতে বসি অনেকগুলো বিষয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলোকে কাগজবদ্ধ করার জন্য। লিখতে থাকি এবং লিখতে থাকি। কমপক্ষে দু-তিন পৃষ্ঠা তো প্রতিদিনই লেখি। তা না হলে মনে হয়, আজকের দিনটিই মাটি!
লেখক নম্বর আট : লেখা নিয়ে কোন চাপাচাপিতে আমি নেই। ভাবনা না আসলে নির্ভাবনায় থাকি। টিভি দেখি, পত্রিকা পড়ি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরামছে বিড়ি টানি! আকাশ দেখি, পাখি দেখি! পাড়ার চায়ের টঙের তেল চিটচিটে বেঞ্চিতে বসে লাল চা পান করি। বউ/বাচ্চা/বান্ধবীর সাথে আলাপে মেতে ওঠি। জীবনে লেখাটাই সব নয়, জীবনবোধেরও দরকার আছে।
লেখক নম্বর নয়: লেখার মুড, নাকি ‘মুডের লেখা’? আমি সকল মুডকে লেখায় প্রয়োগ করি। মুড থাকলেই যদি লিখতে বসি, তবে তো সব লেখা এক রকম হয়ে যাবে! আমি সকল মুডেই লিখতে জানি এবং লিখিও। পাঠক পড়বেন কি না পড়বেন, সেটি অবশ্য আলাদা কথা। আমি লেখি আমার বিচিত্র মুডকে প্রকাশ করার জন্য।
লেখক নম্বর দশ: লেখার জন্য আমার দরকার তিনটি বিষয়, বিড়ি/কফি, ডেডলাইন, কম্পিউটার।
লেখক নম্বর এগারো: লেখা নিয়ে আমি কখনও ভাবি না। কারণ আমি যা ভাবি, তা লিখি না; যা লেখি তার সবই ভাবি না। লেখা শেষে নিজেই বিস্মিত হই, কী ভাবলাম, কী লেখলাম!

লেখক নম্বর বারো: মুড ছাড়াও আরেকটি জিনিস লাগে, যা প্রায়ই মুডের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। ‘বাধ্যবাধকতা’। এটি আসে যখন লেখক অর্থের জন্য লেখেন অথবা ‘অর্জিত সুনাম’ ধরে রাখার জন্য লেখেন। ‘প্রয়োজন’ সকল সৃষ্টির জন্মদাত্রী। বাধ্যবাধকতাও তেমনই একটি বিষয়।

… … … লেখক নম্বর চারশ’ উনিশ (ব্লগার লেখক): মুড কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার, তাহারা কী কী? আমি তো লিখি না, ব্লগিং করি!

লেখক নম্বর চারশ’ বিশ: লেখার মুড না পেলে সবসময়ই আমি যা করি তা হলো, অন্যের লেখা কপি করতে শুরু করে দেই।

ওপরের কোন লেখকের সাথে রাজি বা গররাজি কিছুই হবার সুযোগ নেই। বিষয়গুলো আপেক্ষিক।
লেখক যখন লিখতে বসেন তখন নিশ্চয়ই তিনি একটি ‘মেজাজে’ থাকেন। হতে পারে সেটি চিন্তাশীল অথবা হেঁয়ালী, গম্ভীর অথবা ব্যাঙ্গাত্মক, মনোযোগী অথবা উদাসীন, ক্ষুব্ধ অথবা হৃষ্ট। এই ‘মেজাজ’ নিয়ে তিনি যা লেখবেন, সেটি হয়তো সৃষ্টি করবে প্রেমবোধ অথবা বিষাদ, আনন্দ অথবা বেদনা, আশা অথবা নিরাশা ইত্যাদি। পাঠক হয়তো মনে মনে হাসবেন, অথবা ব্যথিত হবেন। নিরবে অশ্রু ফেলবেন অথবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়বেন। সবকিছু নির্ভর করে লেখক তার লেখার সময় ‘কী মেজাজে ছিলেন’ তার ওপর। গল্প হোক বা কবিতা হোক অথবা প্রবন্ধ হোক, লেখার একটি স্বতন্ত্র মেজাজ থাকবেই। আমি মনে করি, মুডই (মেজাজ) লেখার প্রেরণা বা লেখার সূত্র এনে দেয়। এ বিষয়ে আলোচনা চলতে পারে। বিতর্কও হতে পারে।

কেউ বলেন বসন্ত এলে আমার লেখার ভাব আসে। পাখ-পাখালির ডাক আর ফুলের গন্ধ আমার জন্য নিয়ে আসে লেখার বার্তা। শরতের শুভ্র কাশফুলের মেলা কোন লেখকের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। বলুন, শীত না এলে কি কিছু লেখা যায়? কিন্তু কেউ আবার বলেন, বর্ষাকালই আমার লেখার সময়। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ আমার লেখার মুডকে উসকে দেয়। কেউ বলেন সব ঋতুতেই আমি লিখতে পারি, শুধু রাতটা একটু গভীর হতে হয়।
কেউ কেউ একটু অদ্ভুত কিসিমের। বলে কিনা, হাতের কাজ শেষ না করে আমি লিখতে বসে পারি না! বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে, হাড়িপাতিল ধুয়ে, বাচ্চার বাপরে ‘গুডবাই’ জানিয়ে তারপর আমি লেখার মুড হাতে পাই। বাসনকোসন ধোয়ার সময় হলো বই লেখার পরিকল্পনা করার শ্রেষ্ঠ সময় (আগাথা ক্রিস্টি, ক্রাইম নোভেলিস্ট)। কেউবা বলে, গ্যাসবিদ্যুৎপানির বিল, বাড়িভাড়া, স্কুলের বেতন, গাড়ির তেল, অর্থাৎ মাসের সব বিল পরিশোধ না করা পর্যন্ত আমি লেখায় মন বসাতে পারি না। অতএব লেখালেখি সবকিছু মাসের পনের তারিখের পর।
আরেক পক্ষ আছে যারা ব্লগার নামে পরিচিত। তাদের কেউ কেউ বলেন, ব্লগের টেম্পলেট ছাড়া তাদের লেখার মুড আসে না। এমনকি অফলাইনে বা এমএস-ওয়ার্ডে গেলেও হবে না। ব্লগ ছাড়া লেখার ভাব আসে না!
পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, বা আম্মুর সাথে ঝগড়া হয়েছে, অথবা সোয়ামি/বিবির সাথে কিঞ্চিৎ মনোমালিন্য হয়েছে, অথবা কাছের বন্ধুটির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। এরকম পরিস্থিতিতে কি কিছু লেখা যায়, বলুন?
এরা সকলেই পরিস্থিতির কাছে আবদ্ধ। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে তারা লিখতে পারেন না। ভাবনার স্বাধীনতা হয়তো এদের আছে, তবে সেটি কোন একটি শর্তের অধীন। এটি এক প্রকার মানসিক অবস্থা, লেখার ক্ষেত্রে যাকে নেতিবাচক-ইতিবাচক কিছুই বলা যায় না।
লেখার জন্য ‘ভাবনার স্বাধীনতাকে’ বিবেচনায় এনে, চলুন দুনিয়ার লেখককুলকে দুভাগে ভাগ করে নেই। একদলের নাম দিলাম, গ-িভুক্ত। আরেক দলের নাম গ-িমুক্ত। গ-িভুক্ত যারা, তারা সবসময় লেখার জন্য একটি অজুহাত/কারণ/উসকানির প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। অতএব, লেখার শুরুতে যাদের কথা বললাম, তারা হলেন গ-িভুক্ত।
এবার বলছি গ-িমুক্ত লেখকদের কথা। কবি টাইপের এই লেখকেরা একটু স্বাধীনচেতা। কবি টাইপ বলতে অত্যাবশ্যকভাবে কবি বা কবিতার লেখককে বলছি না। কবিতার লেখক হতে পারেন, অথবা গল্প/প্রবন্ধের লেখকও হতে পারেন। লেখক মানসকে বুঝাচ্ছি। তারা চলন্ত গাড়িতেও দিব্বি লিখে যান! হাঁটতে দৌড়াতে সাঁতার কাটতে ওয়ার্কআউটে ঘুমাতে ইয়ে করতে সবকিছুতে তারা লিখে চলেন। কলম নিয়ে অথবা কলম ছাড়া। কমপিউটারে অথবা শূন্য আকাশে। লিখে অথবা না লিখে। সকল অবস্থায় তারা লিখে চলেন। কিছু লেখা কাগজে পায় প্রকাশ, কিছু লেখা থেকে যায় মস্তিষ্কে। লেখা থেমে থাকে না।
উচ্ছ্বাস আবেগ চেতনা দ্বারা যারা তাড়িত হন, তাদের না আছে পরিস্থিতির প্রয়োজন, না আছে কোন প্রতিবন্ধকতা। মার্কিন কবি ও সমাজকর্মী মায়া এন্জেলোর মতে, মানুষের ভেতরে না-বলা-কাহিনির যে বেদনা, এর চেয়ে পীড়াদায়ক আর কিছু নেই।

লেখক কখনও পরাধীন নন। তিনি পরিস্থিতির অপেক্ষায় থাকেন না, পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। তিনি খ-কালীন লেখকও নন। তিনি দিনের চব্বিশ ঘণ্টা এবং সপ্তাহের সাতদিনই লেখক। হতে পারে, তার অন্য একটি পেশাগত নাম আছে। হতে পারে, তার অন্য একটি সামাজিক পরিচয় আছে। তিনি লেখক সবসময়ের। কিন্তু মনের ভেতর একটি অদৃশ্য দেয়ালের কারণে গভীর জীবনদর্শন থাকলেও অনেকেই লিখতে পারে না। তার আত্মপ্রকাশের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটি মনস্তাত্ত্বিক দেয়াল। নিজে ছাড়া কেউ তা জানে না।
প্রশ্ন হলো, এই মনস্তাত্ত্বিক দেয়াল কীভাবে অতিক্রম করা যায়? লেখক কি সবসময়ই পরিস্থিতি-নির্ভর হয়ে থাকবেন বা থাকেন? আমি মনে করি, না। লেখার চিন্তা মাথায় থাকার পরও লিখতে না পারার এই সমস্যাটি প্রাথমিক পর্যায়ের। কেউ স্বাভাবিক নিয়মেই একে অতিক্রম করেছে, কেউবা সচেতন চেষ্টার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।
মনস্তাত্ত্বিক দেয়ালটি ভাঙার জন্য প্রথমেই নিজের সাথে বোঝাপড়াটুকু শেষ করে নেয়া প্রয়োজন। বিষয়টি একান্তই নিজের সাথে নিজের। প্রশ্নটি হলো কেন লেখক হতে হবে? কী ‘বিষয়’ আছে যে, তা লিখে যেতে হবে? ডায়েরি লিখে লেখক হয়েছিলেন জার্মানির অ্যান ফ্রান্ক। তিনি বলেছিলেন, লেখার মধ্য দিয়ে আমি সব (নেতিবাচকতা) ঝেড়ে ফেলতে পারি। আমার দুঃখ সব দূর হয়ে যায়, সেখানে জন্ম নেয় সাহস। তার মতে, লেখার মধ্য দিয়ে সমাজে নিজের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
যারা নিজের সময়-সমাজ-প্রেক্ষিতকে ইতিহাসের ক্যানভাসে এঁকে যেতে চান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, তারা লেখা থেকে শক্তি পাবেন। মার্কিন ছোটগল্প লেখক স্কট ফিটজেরাল্ট বলেছেন, আপনি ‘বলতে চান’ বলেই যে লিখছেন বিষয়টি তা নয়, বরং আপনার ‘বলার কিছু আছে’ বলেই আপনি লেখেন।
জীবনকে এর নিজস্বতায় না দেখলে এই বলার ভঙ্গি সৃষ্টি হয় না। এটি আসে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেইÑ জীবনকে যাপন করার মধ্য দিয়ে। সচল রাখতে হয় স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো: আনন্দ পাওয়া, মজা পাওয়া, বিস্মিত হওয়া, তৃপ্ত হওয়া ইত্যাদি। লেখক নিজে যদি বিস্মিত না হন, তবে তার কথা পাঠককে কখনও বিস্মিত করবে না। লেখক অনুভূতিপ্রবণ। তার অশ্রু ঝরলে পাঠকেরও অশ্রু ঝরবে (রবার্ট ফ্রস্ট)।

মনস্তাত্ত্বিক দেয়াল। প্রতিনিয়ত আমরা ভেতরের অগণিত দেয়াল ভেঙ্গে চলি। এভাবে আমরা সামাজিক প্রাণীতে উন্নীত হই। মনে পড়ে, প্রাইমারি স্কুলের লাজুক সময়ের কথা অথবা ছোটবেলার স্বার্থপর সময়গুলোর কথা, যখন সবকিছুকে ‘নিজের’ মনে হতো? দেয়াল ভাঙ্গার মধ্যেই যেন নিজেকে প্রকাশের সকল রহস্য আটকে আছে। লিখতে গেলে প্রথম যে দেয়ালটি ভাঙতে হয় তা হলো, নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে ভয়ঙ্কর অবিশ্বাসের দেয়াল। এত লেখকের ভিড়ে আমি আর কী লিখবো, এরকম মনোভাব লেখক সত্ত্বাকে জন্মের আগেই মৃত্যু ঘটায়।

লেখক হবার বিষয়টি স্বাভাবিক হোক, কিংবা সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে হোক, লেখক কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেন। স্বাভাবিক ধারাতেই দেয়াল ভেঙ্গে চলেন। এগুলো তাকে লেখক হিসেবে স্বাধীন সত্ত্বা দান করে। অভ্যাসবশতই মানুষ এমন কিছু করে, যা তাকে লেখক হিসেবে গড়ে তোলে। যেমন: বইপড়া, প্রকৃতির প্রতি অনুভূতিশীল হওয়া, রোজনামচা রাখা ইত্যাদি। কেউবা ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছু অতিরিক্ত কাজ করেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি লেখকের মনোভাব লাভ করেন। এসব নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করার চেষ্টা করেছি। কিছু বিষয়কে আমি তারকাচিহ্নিত করেছি, যা নবীন লেখকদের জন্য বিশেষ উপকারী।

লেখার প্রেরণা যেভাবে আসতে পারে

প্রিয় লেখকের বই পড়া : প্রিয় এবং নিজের ঘরানার লেখক/বিষয়ে বই পড়া। পড়ার বিকল্প একটি বিষয়ই আছে। সেটি হলো, পড়া। ইন্টারনেটের যুগে ‘পড়া’ আরও সহজ হয়েছে।
প্রচলিত মাধ্যমের সাথে সংযোগ রাখা: অনেক সময় একটি সিনেমা দেখে লেখক অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পূর্ণ মৌলিক একটি রচনা সৃষ্টি করেন। ব্লগ/পত্রিকা পড়া, নাটক দেখা এবং বন্ধুর সাথে আড্ডা দেবার অভ্যাসকে ধরে রাখা।
চোখ-কান-নাক সচল রাখা: নিজের পর্যবেক্ষণকে সচল রেখে এবং অনুভূতিশীল থেকে সামাজিক জীবনকে বোঝার চেষ্টা থাকা।
* লেখার উদ্দেশ্য থাকা: লেখকের একটি উদ্দেশ্য থাকা খুব দরকার। নজরুল চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিলুপ্তি আর নিজের সমাজে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য। স্টিভ জবসের বায়োগ্রাফার (ওয়াল্টার আইজাকসন) চেয়েছিলেন তার লেখায় স্টিভ জবসকে মানুষ চিনুক।
লেখার অডিয়েন্স ঠিক থাকা: লেখার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পাঠকশ্রেণি লেখকের মনে থাকা জরুরি। অনেক নবীন লেখক আছেন, যারা পাঠকদের মনোভাবকে লক্ষ্য করে লেখেন। এটি অবশ্য সকলের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়।
*প্রতিদিন লেখা: লেখক হতে চাইলে আপনাকে প্রতিদিন লেখতে হবে, কারণ (পানি আনতে) কূয়োর কাছে আপনি মাঝে মাঝে যান না, প্রতিদিনই যান (ওয়াল্টার মোসলি)।
সহজ উপস্থাপনা: লেখার বিষয় ও ভাষাকে যথাসম্ভব সহজ ও প্রাঞ্জল রাখার চেষ্টা। সহজ পথে চললে স্বাভাবিকভাবেই গতি আসে।
*ঘুমানো/ ঠা-া মেজাজ: সুযোগ পেলে লেখার পূর্বে ঘুমিয়ে নেওয়া। ঘুমের ওপর ওষুধ নেই। সেরা মুড-বুস্টার। মেজাজ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকলে ভালো। এলক্ষ্যে অনেকে ইয়োগা চর্চা করেন।
গুণী মানুষের উদ্ধৃতি: উদ্ধৃতিকে বলা যায় একেকটি দর্শন-কণা যা একটি জীবনমুখী সত্যকে মূর্ত করে তোলে। লেখার ধারণা সৃষ্টি করার জন্য উদ্ধৃতি বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে।

ধর্ম ও ইতিহাস: ধর্মীয় পুস্তক এবং ইতিহাস উভয়েরই নিজস্ব কিছু তথ্য ও সত্য রয়েছে, যা না পড়লে অন্য কোথাও জানার সুযোগ নেই। অথচ লেখকের প্রেরণার জন্য তা অত্যন্ত প্রয়োজন।
নিজস্বতাকে গ্রহণ করা: সবারই স্বকীয়তা আছে। কথা বলার ভঙ্গি যেমন এক নয়, লেখার ভঙ্গিও সকলের এক হয় না। নিজের স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গিকে বুঝা এবং মেনে নেবার মধ্যে লেখক স্বত্ত্বা গড়ে ওঠে।
লেখক পরিচয় : লেখক হিসেবে পরিচয় দেওয়া। তাতে লেখক হিসেবে দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও, পরিশেষে বিশাল সুফল নিয়ে আসে।
লেখক মানস : লেখকের মনে থাকতে হয় লেখকের মানসিকতা। বিষয় থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আলাদা করা। ব্যক্তি অতিক্রম করে বিষয়ে মনেযোগ দেয়া। নিজের সমাজ-পরিস্থিতিকে লেখ্যরূপ দেবার সার্বক্ষণিক চিন্তা।
মানুষের সাথে সম্পর্ক : মানুষের সাথে সহজাত সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আসে লেখার মৌলিক উপাদান। মানুষের আচরণকে বুঝতে না পারলে লেখার বিষয় খুঁজে পাওয়া কঠিন।
প্রেরণার নিজস্ব উৎসকে খুঁজে নেওয়া : ভিক্টোর হুগো কফির গন্ধ না পেলে লেখতে পারতেন না।
* নোট রাখা : যখন ভাবনা তখনই লিখে রাখার ব্যবস্থা রাখা। নোটবুক/ ডায়েরি/ ট্যাব/ স্মার্টফোনে লিখে রাখলেই পাখির মতো চঞ্চল ভাবনাগুলোকে আটকে রাখা যায়।
* মুক্তলেখা : দিনের একটি স্বস্তিদায়ক সময়কে বেছে নিয়ে ১০ মিনিট যে কোন বিষয়ে লেখা।
* ছোট ছোট কথা : হয়তো সব লেখাই সাহিত্য হবে না। তবু সবকিছু লিখে প্রকাশ করার অভ্যাস রাখুন। ফেইসবুকে হলেও লিখুন। বন্ধুকে মেসেজ পাঠাবেন: যতœ করে গুছিয়ে লিখুন আপনার বার্তা। ছোট ছোট কথা হতে পারে ভবিষ্যত লেখার পাথেয়।

লেখার মুড/মনোভাববিষয়ক এই লেখাটিতে শুধুই কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো। কোন নীতিমালা বা মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। পাঠক আছেন বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন পথের ও মনোভাবের। সবার জন্য সবকিছু একই সাথে প্রযোজ্য হবে না, হবার নয়।

মন্তব্য করুন