শামসুর রাহমানের একগুচ্ছ কবিতা

 যদি তুমি ফিরে না আসো

তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।

আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে

তুমি

আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো

আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো

তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তুহীন উদ্যানের পথ, দেখছো

তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,

আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে

তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল

আমি ভাবতেই পারি না।

যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি

আমাকে ভুলে যেতে পারো,

যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া

কোনো উপন্যাস, তখন ভয়

কালো কামিজ প’রে হাজির হয় আমার সামনে,

পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,

তখন

একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে,

আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে

অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন

ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।

বিদায় বেলায় সাঝটাঝ আমি মানি না

আমি চাই ফিরে এসো তুমি

স্মৃতি বিস্মৃতির প্রান্তর পেরিয়ে

শাড়ীর ঢেউ তুলে,সব অশ্লীল চিৎকার

সব বর্বর বচসা স্তব্দ করে

ফিরে এসো তুমি, ফিরে এসো

স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়

মিশে যাও স্পন্দনে আমার।

 

অভিশাপ দিচ্ছি

আজ এখানে দাড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে

অভিশাপ দিচ্ছি।

আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ঞপক্ষ

দিয়েছিলো সেঁটে,

মগজের কোষে কোষে যারা

পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ

দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,

যারা গনহত্যা

করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে

আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক

পশু সেই সব পশুদের।

ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের

সারিবদ্ধ দাঁড়

করিয়ে নিমিষে ঝা ঝা বুলেটের বৃষ্টি

ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।

হত্যাকে উতসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে

ক্যাম্পাসে বাজারে

বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভতস গন্ধ দিয়েছে

ছড়িয়ে,

আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না

কামনা।

আমাকে করেছে বাধ্য যারা

আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত

সিড়ি ভেন্গে যেতে আসতে

নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে

অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।

 

রাজকাহিনী

ধন্য রাজা ধন্য,

দেশজোড়া তার সৈন্য!

পথে-ঘাটে-ভেড়ার পাল।

চাষীর গরু, মাঝির হাল,

ঘটি-বাটি, গামছা, হাঁড়ি,

সাত-মহলা আছে বাড়ি,

আছে হাতি, আছে ঘোড়া।

কেবল পোড়া মুখে পোরার

দুমুঠো নেই অন্ন,

ধন্য রাজা ধন্য।

ঢ্যাম কুড় কুড় বাজনা বাজে,

পথে-ঘাটে সান্ত্রী সাজে।

শোনো সবাই হুকুমনামা,

ধরতে হবে রাজার ধামা।

বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা,

সাজতে হবে বোবা-কানা।

মস্ত রাজা হেলে দুলে

যখন-তথন চড়ান শূলে

মুখটি খোলার জন্য।

ধন্য রাজা ধন্য।

 

ট্রেন

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে

ট্রেনের বাড়ি কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।

দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।

থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।.

 

আসাদের শার্ট

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।

 

বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে

নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো

হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়

বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট

উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।

ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত

মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট

শহরের প্রধান সড়কে

কারখানার চিমনি-চূড়োয়

গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে

উড়ছে, উড়ছে অবিরাম

আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,

চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।

মন্তব্য করুন