১৫ আগস্ট ভয়ঙ্কর সেই রাতের কথা/সুপ্রিয়া বিশ্বাস

অন্য দিনের মত সেদিনও রাত ৮টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জানতেন না, সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিক তখন বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্য এক হতাযজ্ঞের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কয়েক ঘণ্টা বাদে নিজের বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ঘাতকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন- “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি; তার আগেই ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় বাংলাদেশের জনকের প্রাণ। তার পরিবারের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও রেহাই পায়নি সেই রাতে। ১৪ই আগষ্ট ১৯৭৫সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো সচল হয়ে ওঠে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণের একটি ইউনিট থেকে ১০৫ মিলিমিটার কামানগুলোকে ভারী ট্রাক দিয়ে টেনে কুর্মিটোলায় নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য। রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে। এয়ারপোর্টে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক একত্রিত হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর আজিজ পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী প্রমুখ সেখানে জড়ো হন।

১৫ অগাস্ট প্রথম প্রহরে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান অফিসারদের নির্দেশ দেন, বিমানবন্দরের কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে মিলিত হতে হবে। অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন ফারুক। তিনিই অফিসারদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানান। প্রধান টার্গেট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় সেখানে। সিদ্ধান্ত হয়, ওই বাড়িকে ঘিরে দুটো বৃত্ত তৈরি করা হবে। ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে। বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা ভেতর থেকে সেনাবাহিনীর কোনো আক্রমণ এলে তা ঠেকানোর দায়িত্বে থাকবে বাইরের বৃত্তের সদস্যদের। বাইরের বৃত্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নূর ও মেজর হুদাকে। ঠিক হয়, তারা ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোড, সোবাহানবাগ মসজিদ এবং ৩২ নম্বর ব্রিজে রোড ব্লক করবে। বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধানমণ্ডিতে শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায়ও আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। ডালিমকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণের সময় উপস্থিত থাকতে বলেন মেজর ফারুক। কিন্তু ‘পূর্ব সম্পর্কের অজুহাতে’ ডালিম বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণে না গিয়ে সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব নেন। ভারী মেশিনগান বসানো দ্রুতগতির একটি জিপে রওনা দেন ডালিম। সঙ্গে এক প্লাটুন সৈন্যসহ একটি বড় ট্রাক।

শেখ মণির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খানকে। তার সঙ্গে দেওয়া হয় দুই প্লাটুন সৈন্য।এক কোম্পানি সেনাসহ রেডিও স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ মার্কেট এলাকার দায়িত্বে থাকেন মেজর শাহরিয়ার। পিলখানায় বিডিআরের তরফ থেকে কোনো ধরনের আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার দায়িত্বও ওই গ্রুপকে দেওয়া হয়। ২৮টি ট্যাংক নিয়ে শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নেন মেজর ফারুক নিজে। সেসব ট্যাংকে গোলা না থাকলেও মেশিনগানে প্রচুর গুলি ছিল।মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের জন্য ১২টি ট্রাকে সাড়ে তিনশ সাধারণ সৈনিককে তৈরি করা হয়। সরাসরি আক্রমণে মেজর রশিদের কোনো দায়িত্ব ছিল না। তার দায়িত্ব ছিল হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্বয় করা। তার নেতৃত্বে থাকা ১৮টি কামানে গোলা ভর্তি করে যুদ্ধাবস্থার জন্য তৈরি রাখা হয়। কামানগুলো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে তাক করা হয়। একটি ১০৫ এমএম হাউইটজার কামান রাখা হয় আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনের অধীনে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে লেকের পাড়ে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে তাজা বুলেট দেওয়া হয়।

ঘাতকের দল বিমানবন্দর এলাকা থেকে ভোররাত ৪টার দিকে ধানমণ্ডির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। ফারুকের নেতৃত্বে ২৮টি ট্যাংক বিমানবন্দর সড়কে বনানীর এমপি (মিলিটারি পুলিশ) চেকপোস্ট দিয়ে সেনানিবাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে ফজরের আজান পড়ে যায়। ফারুক তার ট্যাংক নিয়ে ৪৬ ব্রিগেড ইউনিটের লাইনের একেবারে ভেতর দিয়ে বাইপাস সড়ক ধরে সেনাসিবাসের প্রধান সড়কে চলে আসেন। ঢাকা সেনানিবাসে সে সময়ে বিমানবাহিনীর যে হেলিপ্যাড ছিল, তার ঠিক উল্টো দিকের একটি গেইট দিয়ে বিমানবন্দরের (পুরনো বিমানবন্দর) ভেতর ঢুকে পড়েন তিনি। এ সময় ফারুককে অনুসরণ করছিল দুটি ট্যাংক। বাকি ট্যাংকগুলো পথ হারিয়ে জাহাঙ্গীর গেইট দিয়ে ফার্মগেইটের দিকে এগোতে থাকে। ফারুক এয়ারপোর্টের পশ্চিম দিকের দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে উপস্থিত হন।

পনেরই অগাস্ট, ১৯৭৫। ভোর সোয়া ৫টার দিকে মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসায় আক্রমণ হয়। শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা করে ঘাতকরা। প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। ডালিমের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে), ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই), তিন অতিথি এবং চারজন গৃহকর্মীকে।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে যান। যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তার বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিল বাসার কর্মচারী মো. সেলিম (আব্দুল) ও আব্দুর রহমান শেখ (রমা)। উপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করতে থাকেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্র বাড়ির দিকে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে ওঠেন গৃহকর্মী আব্দুল আর রমা। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে মূল ফটকের বাইরে গিয়ে দেখেন, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন। দোতলায় গিয়ে দেখেন, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা আর দোতলায় দাঁড়িয়ে না থেকে তিনতলায় চলে যান এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে তোলেন। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পড়ে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত। রমা দোতলায় শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে তোলেন। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কক্ষে যান।ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি …”।বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি।একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরোয় মহিতুলের ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন। এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলি থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার ওই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, “এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?”এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু দোতলায় চলে যান। বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আর্মি আর পুলিশ ভাইয়েরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।”এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই মেজর নূর, মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম খান। কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করেন বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, “আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন। ”মহিতুল ঘাতকদের বলেন, “উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।”এই কথায় খুনীরা আরো নিশ্চিত হয়ে যায় যে ইনিই শেখ কামাল।এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা তার হাতের অস্ত্র দিয়ে শেখ কামালের ওপর ব্রাশফায়ার করেন। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। এর মধ্যে একটা গুলি মহিতুলের হাঁটুতে, আরেকটা নুরুল ইসলামের পায়ে লাগে। এ অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে নুরুল ইসলাম তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। অস্ত্রটা তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে ঢুকে বজলুল হুদা সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। ভবনের নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দোতলায় তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বল। ”তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু।তিনি তাকে বলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।” জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, “আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্য হাউজ?”

বঙ্গবন্ধুর ফোন পাওয়ার পর কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন গাড়িচালক আয়েনউদ্দিন মোল্লা। কিন্তু পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েনউদ্দিন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেইটের সামনে মহিতুল, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সারি বেঁধে দাঁড় করানো হয়। ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্যকে গুলি করলে তিনি পড়ে যান। এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী।ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন ঘাবড়ে যান। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি- বেয়াদবি করছিস কেন?”এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝিতে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ান।সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে গুলি করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। নিথর দেহ পড়ে থাকে সিঁড়ির মধ্যে। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে। বঙ্গবন্ধুর পেছন পেছন রমাও যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘাতকরা তাকে ঘরের মধ্যে চলে যেতে বলে। এর মধ্যে দোতলায় শেখ রেহানার (তখন বিদেশে) ঘরে থাকা তার চাচা শেখ নাসের ওই কক্ষে যান। তার হাতেও ছিল গুলির ক্ষত। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে রমাই প্রথম জানান, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়েছে। এ সময় ওই ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের ও রমা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যদলসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকেন। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যান। তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করেন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তখন দরজা খুলে দেন এবং ঘরের মধ্যে যারা আছেন, তাদের হত্যা না করার অনুরোধ করেন। কিন্তু ঘাতকরা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকে। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী। চিৎকার করে বলেন, “আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।”ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানালে ঘাতকরা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যায়। আর ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।বঙ্গবন্ধুর ঘরে আগে থেকেই ছিলেন শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ সবাইকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামালের মুখ। ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে এরপর নিচে নিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হয়। এ সময় শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, “আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।” এরপর এক ঘাতক শেখ নাসেরকে বলে, “ঠিক আছে। আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসেন।” এই বলে তাকে অফিসের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে গোঙাতে থাকেন। তখন শেখ নাসেরের ওপর আরেক দফা গুলিবর্ষণ হয়।

১১ বছরের শেখ রাসেল লাইনে দাঁড়িয়ে প্রথমে রমাকে এবং পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?” মহিতুল জবাব দেন, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।”এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা তাকে জোর করে মহিতুলের কাছ থেকে নিয়ে দোতলায় নিয়ে যেতে বলেন। আজিজ পাশার কথামত এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রাসেলের চোখ বেরিয়ে যায়। মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে যায়। দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে। এই হত্যাযজ্ঞে ঘরের মেঝেতে রক্তের মোটা স্তর পড়ে যায়। এর মাঝেই লুটপাট চালায় ঘাতকের দল।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন। ছোট বোন শেখ রেহানাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন তারা। দাফনপরদিন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার আব্দুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর লাশ ছাড়া ১৫ আগস্টে নিহতদের সবার লাশ দাফন করেন। আব্দুল হামিদ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে কফিনে নিহতদের লাশ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে শেখ মণি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সদস্যদের লাশ সংগ্রহ করে বনানী গোরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেন। বনানী কবরস্থানে সারিবদ্ধ কবরের মধ্যে প্রথমটি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের, দ্বিতীয়টি শেখ নাসেরের, এরপর শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, শেখ রাসেল, ১৩ নম্বরটি শেখ মণির, ১৪ নম্বরটি আরজু মণির, ১৭ নম্বরটি সেরনিয়াবাতের।আর বাকি কবরগুলো সেদিন ওই তিন বাড়িতে যারা নিহত হন, তাদের।

১৬ অগাস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানে তাকে দাফন করা হয় তার বাবার কবরের পাশে। সেনাবাহিনীর ওই হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শমশের আলী।

তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এ এফ এম মহিতুল ইসলাম, আব্দুর রহমান শেখ (রমা), মো. সেলিম (আব্দুল), অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মো. কুদ্দুস শিকদার, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদ, সাবেক সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ, আয়েনউদ্দিন মোল্লা (সোবহানবাগে নিহত বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনের গাড়িচালক) এর সাক্ষ্য এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদের বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন।পরিমার্জন ও পুনর্লিখন: সাজিদুল হক।পরিমার্জন ও পুনর্লিখন: সুপ্রিয়া বিশ্বাস।