অনন্য সঙ্গীত প্রতিভা সুধীন দাশ ll অনিন্দ্য হাসান

সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছেন সুধীন দাশ তাঁদের অন্যতম। তিনি ৩০ এপ্রিল ১৯৩০ – ২৭ জুন ২০১৭  জন্মগ্রহণ করেন। সঙ্গীতের প্রতিটি শাখায় তিনি সদর্পে বিচরণ করে নিজেকে সঙ্গীতের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। বাংলা গানকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসীম। তাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে নজরুল সঙ্গীতের আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের বাণী ও সুর অনুসারে স্বরলিপি গ্রন্থ লেখা। সুধীন দাশ এ পর্যন্ত নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে ১৬টি ও নজরুল একাডেমি থেকে ৫টিসহ মোট ২১টি খণ্ডে নজরুলের গানের স্বরলিপি গ্রন্থ বের করেছেন। লালনগীতির ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তিনিই প্রথম লালনগীতির স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

সঙ্গীতক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

সুধীন দাশের জন্ম কুমিল্লা শহরের তালপুকুরের বাগিচাগাঁওয়ে। তাঁর বাবা নিশিকান্ত দাশ ও মা হেমপ্রভা দাশ। তিন বড় বোন ও ছয় বড় ভাইয়ের পর তিনি জন্ম নেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাউন্ডুলে ধাঁচের ছিলেন। তবে পড়াশোনায় বরাবরই ভালো করতেন। তাঁর হাতেখড়ি হয় বামচন্দ্র পাঠশালায়। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে তিনি ঈশ্বর পাঠশালায় ভর্তি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সেই পাঠাশালাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে

কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এসময় দাবা খেলার নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। এসব কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর বিএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি

দাদা (বড় ভাই) সুরেন দাশের কাছ থেকে তিনি সংগীতের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। সুরেন দাশ সংগীতের শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মায়ের ইচ্ছে থাকার পরেও প্রথম প্রথম তিনি সুধীন দাশকে গান শেখাতে চাইতেন না। তিনি চাইতেন, সুধীন আগে পড়াশোনা শিখুক। কিন্তু তিনি যে ঘরে ছাত্রছাত্রীদের গান শেখাতেন, সে ঘরের পেছনে এসে সুধীন দাশ দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর সময় পেলে মাঠে গিয়ে গলা সাধতেন। একদিন সুরেন দাশ রেগে গিয়ে তাঁর শিক্ষার্থীদের বলেন, এত চেষ্টা করেও তোমাদের শেখাতে পারছি না, অথচ ঘরের পেছনে যারা ঘুরঘুর করছে, তারা তো ঠিকই শিখে চলে যাচ্ছে!” সুধীন দাশের মতে, এই কথাগুলো ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা।

১৯৪৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় রেডিওতে অডিশন দেন সুধীন দাশ। সে-সময় নিয়মানুযায়ী বোর্ডে একজন অংশগ্রহণকারীকে তিনটি গান গাইতে হতো। কিন্তু সুধীন দাশের গান এত ভালো হয়েছিল যে, তালিকাভুক্তি বোর্ডের সদস্যরা মুগ্ধ হয়ে তার কাছে ১৬টি গান শোনেন। রেডিওতে তিনি রাগপ্রধান গান বেশি গাইতেন। সাথে পঞ্চকবির গান। এরমধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ছিল অন্যতম। শোনা যাক তাঁর মুখেই, ‘রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা অফিস ছিল চানখারপুলে। দোতলা দালানে তিনটি স্টুডিও। একটা একটু বড়, সেখানে নাটক হতো। অন্যটিতে সংবাদ, আরেকটিতে গান আর আলোচনা। মহড়া করতাম দোতলার বাইরের বারান্দায়। কোনো রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা ছিল না। সরাসরি গাইতে হতো। মাসে চার বার কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসতাম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১০টি গান গাইতে হতো। প্রতিদিনের জন্য পাওয়া যেত ১০ টাকা, মাসে ৪০ টাকা। যাতায়াত খরচ বাদে পকেটে থাকত ২০ টাকা। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নামে শিল্পীর অনুকূলে চেক হতো।’ এ সময় গান সুর করার একটা সুযোগও তিনি পান। যেহেতু সুরকারের অভাব ছিল, তাই অন্য শিল্পীরা নতুন নতুন গানের জন্য তাঁর ওপর নির্ভর করতেন। একটা গান সুর করলে পাওয়া যেত ৫ টাকা। আয়-রোজগার দিন দিন বাড়তে থাকে। ১৯৬৫ সাল থেকেই তিনি টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত হন।

১৯৪৮ সালে বেতারে নিয়মিতভাবে নজরুল সংগীত গাইতে শুরু করেন সুধীন দাশ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তিনি মনোনিবেশ করেন নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়ণে। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সেই স্বরলিপি উদ্ধারের কাজে তাঁকে সহায়তা করেন স্ত্রী নীলিমা দাশ। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে ২৫টি স্বরলিপি নিয়ে নজরুল সুরলিপির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ করে নজরুল একাডেমি। পরে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আরও ৩৩টি খণ্ড ।

প্রথমে বেতার জীবনে বিভিন্ন জনের সুর করলেও সিকান্দার আবু জাফরের নাম তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন। সুধীন দাশ জানালেন, সিকান্দার আবু জাফর দেশের গানের পাশাপাশি প্রেমের গান রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। যেমন—আমার জানলা দিয়ে যখন তখন করত যাওয়া আসা/ দেখি সে দুটি চড়ই পাখির বাসা। এ গানটি প্রথমে আমি গাইলেও পরে নীলুফার ইয়াসমীন গেয়েছেন। গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।

সুরকার হিসেবে সুধীন দাশ কতখানি জনপ্রিয় ছিলেন বা কতখানি ভালো সুর করতে পারতেন তা বোঝা যায় পরের গল্পে। একবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রযোজক কাজী আবু জাফর সিদ্দিক নজরুলের ‘ঝিলিমিলি’ নাটকের জন্য নজরুলের ১০টি অপ্রকাশিত গান সুর করার দায়িত্ব দেন সুধীন দাশকে। সুধীন দাশ বিনয়ের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এই বলে যে, নজরুলের গান সুর করার মতো যোগ্যতা তাঁর নেই। কিন্তু লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সুর করতে হয়। ১০টি গানই গেয়েছেন ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী। ‘শুকালো মিলন মেলা আমি তবে যাই’—নজরুলের এ গানটি সুধীন দাশের সুরে গাওয়া হয়। অন্য গানগুলোর কথা তিনি আর স্মরণ করতে পারেন না।

সংগীতে অবদানের জন্য সুধীন দাশ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য পুরস্কার-পদক-সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৮৮ সালে একুশে পদক ছাড়াও তিনি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা, রাইটার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সম্মাননা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক, নজরুল পদক, নজরুল একাডেমি চুরুলিয়া সম্মাননা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের সম্মাননা, কথা ললিতকলা একাডেমি গুণীজন সম্মাননা, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা, নজরুল জন্ম শতবর্ষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্মাননা, সুরসপ্তক আজীবন সম্মাননা, আমীন জুয়েলার্স-এর ৫০ বছর পূর্তি সম্মাননা, শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক, দোলনচাঁপা সংগীত নিকেতন পদক, গীতাঞ্জলী সম্মাননা পদক, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ উচ্চাঙ্গ সংগীত ফোরাম সম্মাননা , বাংলা একাডেমি পদক, বেগম জেবুন্নেছা মাহবুবুল্লাহ ট্রাস্ট স্বর্ণপদক ইত্যাদি পদক লাভ করেন।

সুধীন দাশের স্ত্রী নীলিমা দাশ ছিলেন তাঁর বড় ভাই সুরেন দাশের ছাত্রী। এই সূত্রেই তাঁদের দুজনের পরিচয় হয় এবং ১৯৫৫ সালে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর ছেলে নিলয় দাশ এবং মেয়ে সুপর্ণা দাশ দুজনেই সঙ্গীতশিল্পী। ২০০৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাঁর ছেলে।

ছেলে মারা যাবার পর থেকে স্ত্রী, মেয়ে এবং দুই নাতি দীপ ও ঐশীকে নিয়ে সুধীন দাশ তাঁর মিরপুরের বাসায় থাকতেন।

তাঁর জামাতার নাম হাসান মাহমুদ স্বপন।

সুধীন দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যাও ছিল তাঁর। ২৬ জুন, ২০১৭ তারিখ রাতে তাঁর জ্বর আসে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে নাপা ও প্যারাসিটামল খাওয়ানো হয়। রাতে জ্বর কমেনি, বরং ২৭ জুন সকালে অবস্থার আরও অবনতি হয়। এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মেয়ে তাঁকে কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নিলে ডাক্তাররা জানান, আইসিইউ খালি নেই। পরবর্তীতে অ্যাপেলো হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখেন। রাত ৮টার সময় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

সুধীন দাশকে ১৯৮৮ সালে একুশে পদক দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে চ্যানেল আই নজরুল মেলায় আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। পেয়েছেন মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, নজরুল একাডেমী পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা।

সূত্র : উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ

দেনিক ইত্তেফাক

দৈনিক প্রথম আলো

ছবি : গুগল

মন্তব্য করুন