কবি ও কথা সাহিত্যিক হালিম আজাদ : জীবন ও কর্ম/ নাসির আহমেদ কাবুল

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ব্যাক্তিত্ব কবি হালিম আজাদ। হালিম আজাদ তার লেখক নাম। তার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ আবদুল হালিম। তিনি ১৯৫৫ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বক্তাবলী ইউনিয়নের মধ্যনগর গ্রামে এক কৃষি ও সংস্কৃতিমনষ্ক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মলগ্নে পরিবারটি ছিল একটি সচ্ছল কৃষক পরিবার। পিতা মোহাম্মদ হাকিম আলী ছিলেন বৈঠকী গানের শিল্পী। তার ছিল একটি গানের দল। মাতার নাম আমেনা খাতুন। মা আমেনা এলাকার পরিচিত বংশ লক্ষèীনগর খান বাড়ির মেয়ে। জন্মের পরই হালিম আজাদ নিজ বাড়িতে গান-বাজনার পরিবেশে বেড়ে উঠেন। পিতা বাড়িতেই তার দলবল নিয়ে গানের চর্চা করতেন। তার গানের দল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন আসরে গান করতেন। বড় ভাইও গানের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কৃষি ব্যবসা ছিল পরিবারের মূল কাজ। পরিবারে চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে কবি হালিম আজাদ সবার ছোট।

কবি হালিম আজাদ মধ্যনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, কানাইনগর ছোবহানিয়া হাই স্কুল থেকে এসএসসি, তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ শিক্ষালাভ করেন। তার সংস্কৃতি কাজ শুরু হয় গ্রামে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালে নাটকে পারফরমেন্সের মধ্যদিয়ে। গ্রাম থিয়েটার ‘মধ্যনগর নাট্য সংসদ’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় নাটকে গান ও অভিনয়ে অংশ নেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে গ্রামের একটি যাত্রাদলের মঞ্চে নিজের লেখা ও সুরে একক অভিনয়ের কাব্যগীতি ‘সোনাই’ তিনবার পারফরমেন্স করেন। এরপর থেকে শিশুশিল্পী হিসেবে এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়েন। কানাইনগর হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি বার্ষিক দুটি নাটকে অভিনয় ও গান করেন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় গান পরিবেশন করেন নিয়মিত।

১৯৬৯ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালে স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। একই বছর তিনি ছাত্র রাজনীতিতে (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) যোগ দেন। সেই থেকে তার গান, আবৃত্তি, কবিতা লেখা শুরু। চলে ছাত্র রাজনীতি। ১৯৬৯ সালে জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আজাদ’-এ একটি কবিতা প্রকাশ হয়। সেই থেকে জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে তার কবিতা প্রকাশ অব্যাহত থাকে।
কবি হালিম আজাদ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বক্তাবলীতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণে আনা, শরণার্থীদের সহায়তা, পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে যোগদান, ক্যাম্পের নির্দেশে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহসহ যুদ্ধের বিভিন্ন কাজ করেন। কলেজে অধ্যয়নকালেও তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় তার গান, আবৃত্তি পরিবেশনা, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ এবং পরবর্তীতে উপন্যাস লেখা তোরজোরভাবে চলে। ১৯৭২ সালে তিনি সাহিত্য সংকলন ‘অব্যয় ’ সম্পাদনা করেন। ১৯৭৫ সালে অন্যান্যের সঙ্গে গঠন করেন সাহিত্য সংগঠন ‘অক্ষর’। সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবচারের মতো বাংলাভাষা প্রচলনের ওপর জরিপ পরিচালনা এবং জরিপ তথ্য নিয়ে সমীক্ষা সংকলন সম্পদানা করেন। ১৯৭৬ সালে দেশের শক্তিশালী সাহিত্য সংগঠন ‘ড্যাফোডিল’ প্রতিষ্ঠা এবং এর সভাপতিমন্ডীর সভাপতি ছিলেন তের বছর। সাহিত্য সংকলন ‘ড্যাফোডিল ’সম্পাদনা করেন প্রায় দেড় দশক। এ সময়ে তিনি ড্যাফোডিলের ৬৪টি সংখ্যা সম্পাদান করেন। সংগঠনটি থেকে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ বের হয় এবং তিনি গ্রন্থগুলোর প্রকাশক।
১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি গানের দলের হয়ে সংগীত পরিবেশন করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এই হত্যার বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার। ১৯৭৭ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে  ‘পৃথিবীর কাছে নোটিশ ’ কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ করায় তিনিসহ এই বই প্রকাশের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান সরকার মামলা দায়ের করে। ওয়ারেন্ট বের হলে তিনমাস আত্মগোপনে ছিলেন কবি। ১৯৮৬ সালে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রথম সাহিত্য সংকলন ‘নিরালোকে বসতি ’ সম্পাদনা করেন। সংকলনটি মুক্তধারার একুশে পুরস্কার লাভ করে।
১৯৮৬ সালের ৭ ডিসেম্বর দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সন্ধ্যানী’তে ‘গণতন্ত্র ১৯৮৬’ কবিতাটি লিখেন কবি হালিম আজাদ। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী  স্বৈরাচারী জেনারেল  এরশাদ বন্দুকের জোড়ে ক্ষমতায় বসলে এর প্রতিবাদ করে কবিতাটি লিখেন। কবিতাটি লেখার অপরাধে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮৬ তারিখে দুপুরে প্রেসিডেন্ট এরশাদের নির্দেশে একদল সেনাবাহিনী  ৮১ মতিঝিল তার অফিস (বাংলার বাণী) থেকে কবিকে তুলে নিয়ে যায়। কয়েক ঘন্টা হোটেল শেরাটনের পাশে সেনাক্যাম্পে চোখ বেঁধে তাকে নির্যাতন চালানোর হয় কবির উপর। পরে তাকে বঙ্গবভনে প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাছে নিয়ে যায় সেনা সদস্যরা। প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে বঙ্গভবনে তার অফিস কক্ষে ৩৭ মিনিট ধরে অপমানমূলক কথাবার্তা ও হুমকি প্রদান করে। বিকেলে তাকে পুনরায় গাড়ীতে সেনা সদস্যরা অফিসের সামনে নামিয়ে দেয়া হয়।
কবি হালিম আজাদ ২০১০ ও ২০১২ সালে সম্পাদনা করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘সমমনা’র দুটি সংখ্যা। ২০১৪ সালে সম্পাদনা করেন ঘাতকদের হাতে নিহত মেধাবী সন্তান তানভির মোহাম্মদ ত্বকীর স্বারকগ্রন্থ ‘জনান্তিকে ত্বকী ’।
১৯৭৯ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ করেন। এরপর থেকে গত ৩৪ বছর ধরে দৈনিক যুগান্তর, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থ (বাসস), চ্যানেল আই, সাপ্তাহিক বিচিত্রা এবং  পুনরায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস’র প্রধান বার্তা সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে কর্মরত।
তিনি দৈনিক বাংলার বাণীতে সাত বছর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য হালিম আজাদ এই ক্লাবের বিভিন্ন সাব-কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেন। নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের তিনটার্মে ছয় বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
প্রকাশিত গ্রন্থ, কবিতা : অদ্ভুত দরোজার কাছে (কবিতা), ড্যাফোডিল, প্রকাশকাল ১৯৮২), ভেঙ্গে দাও নারকীয় দেয়াল  (কবিতা,  মুক্তধারা , প্রকাশকাল ১৯৮৫), পাথরের মানুষ (কবিতা, ড্যাফোডিল, প্রকাশকাল ১৯৮৭), কারো কারো দিকে অবিরাম চেয়ে থাকা (কবিতা, আগামী প্রকাশনী, প্রকাশকাল ১৯৮৮), যে তিমির হ্নদয় ছুঁয়ে যায় ( কবিতা, ১৯৮৯), মস্কো টাওয়ারে কিছুক্ষণ (কবিতা, পারিজাত প্রকাশনী, প্রকাশকাল ১৯৯১), কবিতা সমগ্র, (প্রকাশকাল,পারিজাত প্রকাশনী, প্রকাশকাল ২০১২), নির্বাচিত ২০০ কবিতা (পারিজাত প্রকাশনী ,প্রকাশকাল ২০১৩), পৃথিবীর কাছে নোটিশ (সম্পাদনা, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০০ কবির কবিতা, ১৯৭৭), চেতনায় তুমি বিপ্লব (বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সম্পাদিত কবিতাগ্রন্থ, ১৯৮২), নিরালোকে বসতি (সম্পাদনা গ্রন্থ, ১৯৮৫), সাহিত্য সংকলন ‘সমমনা ’ র দুটি সংখ্যা (২০১০ ও ২০১২ ), সম্পাদনা জনান্তিকে ত্বকী (সম্পাদনা গ্রন্ধ ২০১৪)।
উপন্যাস : দূর্বাঘাস আর গ্রেনেডের কল্প ( অন্য প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস প্রকাশকাল ২০০৪, বইটি  শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে চ্যানেল আই আনন্দআলো সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে), মুক্তি¯œান  (মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, ইউনিভার্সেল একাডেমী, প্রকাশকাল ২০০৬), লড়াই (মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, মিজান পাবলিশার্স, প্রকাশকাল ২০০৬), নীল বাংকার (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস, মিজান পাবলিশার্স)।
ছোটগল্প : ঘরে ঘরে যুদ্ধ (মুক্তিযুদ্ধের গল্পগ্রন্থ, প্রকাশকাল ২০০১) গবেষণা ও জীবনীগ্রন্থ : সাংবাদিক-লেখক বেবী মওদুদ ( প্রকাশনায় বাংলা একাডেমী, মার্চ ২০১৫) ।
পুরস্কার :  জাতীয় প্রেসক্লাব সাহিত্য পুরস্কার ( ২০০৩), চ্যানেল আই আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (দুর্বাঘাস আর গ্রেনেডের গল্প’ উপন্যাসটি শ্রেষ্ঠ স্থান), শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (কবিতায় অবদানের জন্য), চারণ সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সাহিত্যপদক, আবুল হাসেম হাসু সাহিত্য পুরস্কার, মধূসদন পদক ২০১৫ (নির্বাচিত ২০০ কবিতা ’ গ্রন্থটি সৃষ্টিশীল কবিতায় শ্রেষ্ঠ স্থান,মাইকেল ফাউন্ডেশন,যশোর ), পদক্ষেপ সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা (কবিতায় অবদান রাখার জন্য, ২০১১) , মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা,মধ্যনগর প্রাক্তন ছাত্র সমিতি,এম নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪,নীল বাংকার উপন্যাস) ।
পেশাগত তথ্য : ১৯৭৯ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ। এর পর থেকে গত ৩৪ বছর ধরে দৈনিক যুগান্তর, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, চ্যানেল আই, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, পুনরায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় চাকুরী করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস’র প্রধান বার্তা সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে কর্মরত। দৈনিক বাংলার বানীতে সাত বছর সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা, অব্যায় (প্রকাশ কাল ১৯৭৬ ).অক্ষর সাহিত্য সংগঠনের পরিচালক (১৯৭৮),মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘ ড্যাফোডিল  (১৯৭৯) এ সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি(১৯৭৯ -১৯৮৯) হিসেবে এ পত্রিাকার ৪৮টি সংখ্যা সম্পাদনা। জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য(বর্তমানে প্রকাশনা ও প্রচার সম্পাদক,পদাবলী (প্রতিষ্ঠাতা সদস্য)।
পেশাগত কাজ ও সাহিত্য বিষয়ক সেমিনার এবং সম্মেলনে যোগদানে সফর
গত পয়ত্রিশ বছরে কবি হালিম আজাদ পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে,সাহিত্য,সাংবাদিকতা বিষয়ক সম্মেলন-সেমিনারে যোগদান উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তার সফর করা দেশগগুলো হচ্ছে ভারত, যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফীনল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

মন্তব্য করুন