আঘ্রাণ/শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়



ছোটো থেকে পড়ে আসা ইস্কুলটাকে বিদায় জানাতে ইচ্ছে করছিল না রিংকুর কিছুতেই। স্টেজের সামনে বকুল গাছটার নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সে..ঐ একতলার কোণার ক্লাসরুম… প্রথম দিন ফাইভে ভর্তি হয়ে ঐ ঘরেই ক্লাস করতে আসা…। বাবা হাত ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়েছিল ঐ সামনের বেঞ্চটায় ছোট্ট রিংকুর চোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে একরাশ জলের ধারা।
‘ আমি তোমার সঙ্গে বাড়ি যাবো বাবা..আমাকে আবার পুরোনো ইস্কুলে নিয়ে চলো..!’
‘ বোকা মেয়ে! আর কি কখনো ফিরে যাওয়া যায় সেখানে? দ্যাখো,তোমার বন্ধুরা সব বসে আছে পাশে.. তারা কি কেউ কাঁদছে? ‘
মন মানে নি রিংকুর।
আজও যেন মানতে চাইছে না, ঠিক সেদিনের মতোই।
কতদিনের চেনা ক্লাসরুমগুলো, সেই চেনা করিডর, বেত হাতে গটগট করে হেড দিদিমণির পায়চারি,ঘুরে ঘুরে ক্লাসরুম তদারকি, কত ম্যাডামকে ঘিরে তৈরি হওয়া কত ভালোলাগা, হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এই মঞ্চটা…যেখানে একটু আগেই ফেয়ার ওয়েলের গান গাইতে উঠেছিল রিংকু…রত্না ম্যাডাম জড়িয়ে ধরেছিলেন গান শুনে.. ‘ এমন সুন্দর গলা তোর.. ধরে রাখার চেষ্টা করিস’… রিংকুর মনে হলো একাকি দাঁড়িয়ে যেন তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্টেজটা..!
অনুষ্ঠান শেষে ফুলের পাপড়ি, এ ওকে দেওয়া কেক,মিষ্টির টুকরো গুলো এখনো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ইতিউতি…খন্ড খন্ড স্মৃতির মতো…হেড দিদিমণি স্কুলের পক্ষ থেকে ক্যামেরায় রিংকুদের গ্রূপ ফটো তুলে রেখেছেন… ক্লাস টুয়েলভ এর ফেয়ার ওয়েলের গ্রূপ ফটো। ওটা বাঁধিয়ে রাখা হবে অফিস ঘরে..অন্যান্য বছরের মতো। কণিকা, রীতা আর মল্লিকার সে কি কান্না! হেড দিদিমণি পরম মমতায় ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছিলেন,’ ভালো রেজাল্ট করা চাই কিন্তু.. স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে তোমাদের.. সবাইকেই বলছি। এই.. এই দ্যাখো বোকা মেয়েরা..আর কত কাঁদবি!’
বলতে বলতে উনিও চশমা খুলে চোখ মুছছিলেন।
বেত হাতে নিয়ে চলা কড়া ধাতের হেড দিদিমণির মনের গহণে যে এত মমতা লুকিয়ে থাকতে পারে… সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল রিংকু যেন!
বকুল গাছটার গায়ে সিমেন্ট বাঁধানো বেদিতে একা একা বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল রিংকু। বন্ধু বান্ধবীদের কত অশ্রুসজল মুখ এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতিউতি। মল্লিকা তো যেতেই চায় না ইস্কুল ছেড়ে। বলছিল, ‘ আজ সারাদিন যদি আমাকে থাকতে দেয়, কেউ না থাকুক আমি এখানেই থেকে যাবো..।’
রিংকুর কেন জানি না মনে হচ্ছিল, আজ সবার মনেই কত কষ্ট… কিন্তু ওরা কেউ একবারও তো এসে বসছে না অন্যদিনের মতো এই বকুল গাছের নীচের বেদিটায়। আর তো পাবে না ওর ছায়া। রিংকুরা ব্যাচের কয়েকজন মিলে নিজের হাতে পুঁতেছিল এই গাছখানা। সাত আট বছরে কত বেড়ে উঠেছে! আরো বেড়ে উঠবে দিনে দিনে। থোকা থোকা ফুলে আলো হয়ে থাকবে। তখন আর রিংকুরা থাকবে না। একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে গাছটা। ভাবতেই কিরকম যেন হু হু করে উঠলো মনটা ওর… এলোমেলো হাওয়ায় শন শন করে ওঠা বকুল পাতার মতো…। এসেছিল একদিন বাবার হাত ধরে… বাগানে লুকোচুরি খেলতে খেলতে, টিফিন বেলায় মাঠময় ধূলো উড়িয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কবে যে নিজের আর একটা বাড়ি হয়ে উঠলো এই ইস্কুলটা..!
হাতে ধরা টুকটুকে লাল গোলাপ ফুলটা নাকের কাছে নিয়ে এসে আঘ্রাণ নিল রিংকু। ভুরভুর করছে গন্ধ। ফেয়ার ওয়েলে ম্যাডামরা দিয়েছেন ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক স্টুডেন্টকে। মাধ্যমিকের আগেও ক্লাস টেন ছেড়ে যাওয়ার সময়ও দিয়েছিলেন।
রিংকুর কাছে এর চেয়ে দামী উপহার আর বোধহয় কিছুই নেই।
‘ কিরে রিংকু, এখানে একা বসে কী করছিস? ওদিকে আমরা সবাই রয়েছি…রীতা খুঁজছে তোকে..জানিস,কি যে খারাপ লাগছে তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা..কাল থেকে আর কারো সঙ্গে দেখা হবে না…কে কোথায় মিলিয়ে যাবো..খুব মিস করবো রে স্কুলটাকে..!’
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ে মল্লিকা। গলা ধরে আসে।
রিংকু বেশ কিছুটা অবাক সুরে বলে,’ স্কুলটাকে মিস করবো। কিন্তু তোদের মিস করবো কেন? তুই,আমি, রীতা, আনন্দি…আমরা তো ঠিক করেই ফেলেছি, সকলে একই কলেজে ভর্তি হবো!’
‘ তা তো হবো..কিন্তু তবু আজকের পর এইদিনগুলো কি আর ফিরে পাবো বল?’
গোলাপের পাপড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রিংকু বলে,’ পেছনের দিনগুলোকে আঁকড়ে থেকে কী হবে বল? যা যাবার সে তো চলে যাবেই। সামনে আর একটা জীবন.. নতুন কলেজ..তাকেও একদিন এ ভাবেই ভালোবেসে ফেলবো…।’
মনের কোণে লুকিয়ে থাকা একটা নতুন দিনের স্বপ্ন যেন চলকে ওঠে রিংকুর চোখে মুখে। কলেজ। নেই বড় দিদিমণির মতো এরকম অনুশাসন। পড়া না পারলে গার্জিয়ান কল্ কিংবা শাস্তির ভয়ে মুখ মাথা নীচু করে সিঁটিয়ে থাকার লজ্জা…। আছে এক অদ্ভুত স্বাধীনতা…! বাড়িতে বাবা প্রায়ই দাদাকে বলেন,’ কলেজে পা দিয়েছিস তো, তাই পাখা গজিয়ে গিয়েছে। কখন যাস,কখন আসিস কিছুই তো বুঝি না। ঐ শুধু উড়ে বেড়ানোই হয় আর কি।’
রিংকু শোনে আর ভাবে, ইস দাদার মতো কবে যে ভর্তি হবো কলেজে! আর থাকবে না ইস্কুলের ভয়। বড় দিদিমণির চোখ রাঙানি, অনুশাসন..। আর তো কটা দিন। বাংলা বইয়ের পৃষ্ঠায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের স্বাধীনতার কবিতাটা মনে পড়ে যায় তার..’আঠারো বছর বয়স’। যে বয়স জানে না কোনো বাধা..।
আঠারোর দোরগোড়ায় পা দেওয়া রিংকু হঠাৎ করেই যেন বড় হয়ে যায় মনে মনে। নিজের কাছে। বাবার হাত ধরে ইস্কুলে আসা সেই ছোট্ট মেয়েটার মনের যে দুঃখ একদিন বাঁধ মানতে চাইতো না,আজ সে নিজেই নিজেকে আড়াল করে সহপাঠীদের ভেজা চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলতে পারে, ‘ তোরা এত কাঁদছিস কেন? কই আমি তো..!’

বুকের গভীরে আরএকবার ফুলের আঘ্রাণটুকু নিয়ে গোলাপের ডাঁটিটা স্বযত্নে নিজের ব্যাগে ভরে মল্লিকার হাতখানা ধরে রিংকু বললো,’ চল ‘।

কদিন পরেই পয়লা বৈশাখ। আগের মতো আর পেরে ওঠেন না অদিতি দেবী। তবু বৎসরান্তে এই একটা দিন অন্তত ঘরগুলোকে ঝাড়পোঁছ না করলে মনটা যে বড় খুঁতখুঁত করে তাঁর।
বাড়ির পুরনো টুলটাতে উঠে, শাড়ির আঁচলটা মাথায় বেঁধে, একটা ঝুলঝাড়ু নিয়ে, গানের কলি গুনগুন করতে করতে ঘরদোর গুলো সাফসুতরো করছিল রিংকু। অদিতি দেবী যতবার মেয়েকে আটকাতে যান..’একদিনের জন্য বাড়ি এসে কোথায় হাত পা ছড়িয়ে বসে গল্প গুজব করবি তা নয়.. কে বলেছিল বল দিকিনি এসব সাফসুতরো করতে..আমি আর তোর বাবা মিলেই তো করে দিতাম’..রিংকু ততোই সরিয়ে দেয় মাকে।
‘ বাড়ির সব কাজ সামলে তুমি আর কত করবে এসব। বয়স হয়েছে। শরীর দেয় কখনো? বাবারও তো কত কাজের চাপ! আগের মতো শরীরও আর নেই..।’
‘ যা ভালো বুঝিস কর বাপু। বাড়ি এসে মেয়ে এখন এইসব কাজ শুরু করলো…ভালো লাগে কারোর!’
গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে পা বাড়ান অদিতি দেবী।
‘ তা হ্যাঁরে, আজ ছুটির দিন। রিপন তো আসতে পারতো। এলো না কেন? কতদিন আসে না।’
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে অদিতি দেবীর গলা।
‘ বলেছিল আসবে। ওদিকে অফিসের বেশ কিছু প্রজেক্টের কাজ বাকি পড়ে আছে। ঐ নিয়েই বাবু কম্পিউটারে ব্যস্ত সারাদিন। লাস্টে আর সময়ই করে উঠতে পারে নি..কি বলবো।’
কাজ করতে করতেই উত্তর দেয় রিংকু।
‘ আর তুই ব্যস্ত মোবাইল, ফেসবুক নিয়ে তাই তো? হয়েছিস বটে দুজনে বেশ ভালোই..!’
মায়ের কথায় নিজের মনেই হেসে ওঠে রিংকু। সাথে হালকা দীর্ঘশ্বাসও যেন বেরিয়ে আসে। এর পরেই হয়তো মা বলতে পারে তাঁর সেই পেটেন্ড কথাটা…’ এভাবে আর কতদিন চলবে বল দিকিনি? এবার কোল আলো করে একটা কিছু..। ওপাশের বাড়ির সন্দীপ্তার তোরই বছরে বিয়ে হয়েছে। অ্যাদ্দিনে বাচ্চাটা ইস্কুলেও যেতে শিখে গেল। একবার খেয়াল করেছিস…!’
কথায় কথায় তখন মনটাই খারাপ হয়ে যাবে রিংকুর। এক কথা থেকে পাঁচ কথা চলে আসবে। আজকাল নিজের বাড়িতে আসতেও ওর কিরকম জড়োসড়ো লাগে। পাড়ার লোকগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে…যেন বলতে চায়…রিংকু জানে ওরা কি বলতে চায়..’ এতদিন বিয়ে হয়ে গেল, এখনো মেয়েটার..!’
পাঁচজনকে নিয়ে চলা শ্বশুর বাড়ি.. সেখানেও যেন অপরাধী মনে হয় নিজেকে। অথচ রিংকু জানে, শ্বশুর বাড়ি তার যথেষ্ট ভালো। কেউ তাকে দোষ দেয় না। কষ্ট দিতে চায় না। সত্যিসত্যিই তো কিই বা দোষ রিংকুর। শেষমেশ যদি কপালে না ই লেখা থাকে…ভাবলে তখন দম বন্ধ হয়ে আসে চারিপাশটা.. মনে হয় ছুটে চলে যাবে কোথাও… যেখানে গেলে দু’ দন্ড নিঃশ্বাস নিতে পারে প্রাণভরে…!

কেন জানি না, রিপনের মুখটা ভেসে উঠলো রিংকুর চোখের সামনে। টুল থেকে নেমে কি মনে করে পাশের টিভি ক্যাবিনেটে রাখা নিজের মোবাইলটা নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করে রিপনকে।
‘ হ্যালো। ‘
‘ কাজ করতে গিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছো তাই তো?’
‘ ওকে ডার্লিং, ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে! এক কাপ কড়া করে কফি খেতে হবে। নইলে মাথাটা ঠিক ছাড়বে না। এখানেই তোমার অভাব বেশী করে ফিল করছি। বউ ছাড়া কেই বা দেবে ওরকম করে কফি বানিয়ে। অগত্যা নিজেকেই..।’
‘ হ্যাঁ একটু নড়েচড়ে ওঠো দেখি। তা না একভাবে সেই কম্পিউটারের সামনে..! ব্রেকফাস্ট করেছো?’
‘ না এখনো..। ‘
‘ এতো বেলা হয়ে গেল..! দেখলে কাজে ডুবে গেলে সব কেমন গন্ডগোল করে ফেলো? ফ্রিজে সব ঢেকে রেখে গেছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’
‘ ওকে এখনই খেয়ে নিচ্ছি।’
‘ এই শোনো না, মা বলছিলেন আজকে আসতে পারবে?’
‘ আচ্ছা দেখছি চেষ্টা করে যদি বিকেলের দিকে সময় পাই কেমন?’
‘ দ্যাখো। রাখলাম।’
নিজের মনেই আবার একঝলক হেসে ওঠে রিংকু। ‘দেখছি চেষ্টা করে’…তার কোনো কথাতেই সেভাবে কোনোদিন না করেনা স্বামীদেবতাটি। সেও এ নিয়ে খুব বেশী জোর করতে চায় না। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ…শেষ না করে কিকরেই বা আসে বেচারা।

দেওয়ালগুলো সাফসুতরো করে তাকে রাখা আসবাবপত্রগুলো ঝাড়পোঁছ করতে করতে হঠাৎই বুক শেল্ফে অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে থেকে কিছুটা সামনে মুখ বের করা একটা অনেককালের পুরনো ডায়েরির দিকে নজর চলে যায় রিংকুর।
হলুদ রংয়ের মলাটের গায়ে ফাউন্টেন পেন এ বড় বড় হরফে লেখা নামটা আজও স্পষ্ট। খাটের ওপর বসে স্কুল জীবনের প্রিয় ডায়েরিটা নিয়ে পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল রিংকু। কতদিনের কত কিছু লেখা..কোনোটা নেহাৎই মনের ভাব..ম্যারমেরে প্রাত্যহিকতা…কোনোটা সত্যিকারের মনের ভাষা….! সব একসাথে মিলে হয়তো একটা খন্ড জীবনের উপন্যাস হয়ে যাবে আজ..! ডায়েরীটা রিপনকে একবার নিয়ে গিয়ে দেখাবে নাকি? না থাক, কত কি গোপনীয়তা… সেকি, রিপনের সামনে আবার গোপনীয়তা কিসের? থাক, শেল্ফের কোণাতেই থেকে যাক বরং লুকিয়ে। ওদিকে কাজ পড়ে আছে কতো!

ডায়েরিটা সবেমাত্র বন্ধ করতে যাবে রিংকু, হঠাৎই একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় খাঁজের মধ্যে লুকোনো দুটো গোলাপের শুকনো বিবর্ণ ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া পাপড়িগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো ওর চোখের সামনে। পাশের পৃষ্ঠায় কালো কালিতে লেখা কয়েকটা লাইন… ‘ ক্লাস টেন ও ক্লাস টুয়েলভ এর বিদায় সম্বর্ধনায় স্কুলের পক্ষ থেকে পাওয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় দুটো উপহার…।’

পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে আবারো।
মল্লিকা। কলেজ ছাড়ার পর বহুবছর আর কোনো দেখাসাক্ষাৎ ছিল না ওর সঙ্গে। গতবছর হঠাৎই সাউথ সিটি মলে পুজো মার্কেটিং করতে গিয়ে রিংকুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ওর। আবার নতুন করে পুরনো বন্ধুত্বে ফিরে আসা। আর মল্লিকার মাধ্যমেই রীতার সঙ্গেও তৈরি হয়ে গেল যোগাযোগের সেতুটা। যেহেতু ঘটনাচক্রে ওদের দুজনেরই শ্বশুর বাড়ি একই জায়গায়।
ফোনটা কানে নিল রিংকু।
‘ হ্যালো।’
‘ এইযে আমার একমেবাদ্বিতীয়ম বেস্ট ফ্রেন্ড.. তুই কোথায়?’
‘ বাপের বাড়িতে। তুই?’
‘ রীতার বাড়ি,নেমন্তন্নে। ছেলে মেয়ে নিয়ে একেবারে সকাল সকাল হাজির। সারাদিন গপ্পো, জমিয়ে খাওয়া দাওয়া…পালা শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় সংসার নিয়ে ঘরে ফেরা… ইস্ কি মিস করলি! এই নে, রীতা কথা বলবে..।’
ওদিক থেকে রীতার গলা বেশ তীক্ষ্ণ শোনা যায়।
‘ কত করে বললাম এলি না..আচ্ছা দেখবো,এক মাঘে শীত যায় না..।’
‘ রাগ করিস না প্লিজ। এদিকে মায়ের কাছে আজ একটু না এলেই হতো না…তোকে তো বলেওছিলাম..।’
‘ কথা নেই। আড়ি। আগে আসিস, তারপর কথা.. এই মল্লিকা ধর।’
রিংকু বোঝানোর চেষ্টা করে.. ‘ শোন না, তোরা একদিন এর মধ্যে আমার বাড়ি আয়। সেই কবে থেকে বলছি। আসছে রবিবার..। ‘
ততক্ষণে মল্লিকার হাতে ফোন চলে গেছে।
‘ না রে, ছেলে মেয়েগুলোর সামনে পরীক্ষা। রীতার মেয়েরও তাই। একই স্কুল। নেহাৎ আজকে ওদের বাড়িতে পুজো ছিল। ঠাকুরের অন্নভোগ। মানসিক করেছিলাম, তাই আসা। পড়াশোনাটা নষ্ট হলো তো ঠিকই। ‘
‘এই জানিস মল্লিকা’ কথাটা যেন আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো রিংকুর মুখ থেকে। ‘আজ একটা বহু পুরোনো জিনিস খুঁজে পেলাম রে! ডায়েরির পাতার ফাঁকে রাখা ছিল।’
‘ কোন্ গুপ্তধন শুনি..?’
‘ তা গুপ্তধনই বলতে পারিস। তোর মনে আছে ফেয়ার ওয়েলের দিন স্কুল থেকে গোলাপ ফুল দেওয়া হয়েছিল আমাদের…। ‘
‘ হ্যাঁ।’
‘ ডায়েরির পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি কুড়ি বছর আগের সেই ফুলদুটো এখনো..!ভাবিনি মা ওগুলো যত্ন করে ঠিক রেখে দেবে। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল আমার। রীতার কথাও। স্কুল মাঠটাতে বসে তোরা কত কেঁদেছিলি সেদিন! আমি কাঁদিনি বলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলি…সত্যিই রে, হারানো দিন গুলো আর ফিরে পাবো না। চাইলেও না। ভাবতে ভাবতেই দেখি তোর ফোন।’
‘ এখনো ভাবিস এসব কথা?’
‘ কেন তুই ভাবিস না?’
‘ সময় কই? নিজের সংসার, ছেলেমেয়েদের পেছনে দৌড়াবো না গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসবো? ও তুই ভাব বসে বসে… একবার রীতার বাড়ি থেকে ঘুরে গেলে কি হতো বল তো? কত আর দূর… ন মাসে, ছ মাসে আবার কবে দেখা হবে…! রাখি রে।’

ডায়েরিটা আবার আস্তে আস্তে নিজের কোলে তুলে নেয় রিংকু।জীবাশ্মপ্রায় ফুলের বৃন্ত দুটো খুব সন্তর্পণে তুলে নেয় নিজের হাতে। অস্তিত্ব আর অনস্বিত্ব..এই দুয়ের মাঝে প্রাণপনে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন..!

বিকেলবেলা রিপন এলো শ্বশুরবাড়িতে। ডিনার শেষে একান্তে রিংকুর হাতখানা জড়িয়ে ধরে রিপন। ভুরু কুঁচকে তাকায়।
‘ কী হয়েছে ডার্লিং? এসে থেকে দেখছি কিরকম চুপচাপ, অন্যমনস্ক। এনি প্রবলেম? নাকি কোনোকারণে আমার ওপর অভিমান?’
ওর চিবুকটা একটু নাড়িয়ে দেয় রিপন।
কিছু বলে না রিংকু। মাথা নীচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রিপন বলে চলে,’ একটু আগে তোমার মা ও বলছিলেন,” মেয়ের কখন যে কি মতিগতি হয়! এই কথার ফুলঝুরি তো এই একেবারে চুপচাপ। দুপুরবেলায় সেই যে জানলার দিকে মুখ করে বসে থাকলো তো থাকলোই…। অথচ সকালে এসে নিজেই ঘরদোর পরিষ্কার করলো…ঝাড়পোঁছ করলো… গুনগুন করে কি সুন্দর গান গাইছিল…কতদিন বলেছি, হারমোনিয়ামটা বাবা তো তোর জন্যে কিনে এনেছিলেন শিখবি বলে…ঘরে থেকে নষ্ট হচ্ছে…নিয়ে যা ওটা…চর্চাও হবে, মনটাও ভালো থাকবে। কে শোনে কার কথা..”। কি গো এনে দেবো একটা হারমোনিয়াম? বলো তো কালই অর্ডার দিই…। অনেকদিন বলেছি, কত ভালো গলা তোমার…চর্চাটা রেখো…। তুমিই তো বলেছিলে, তোমার স্কুলের কোন্ দিদিমণি নাকি ফেয়ারওয়েলের দিন তোমার গান শুনে স্টেজে উঠে জড়িয়ে ধরেছিলেন তোমায়…অথচ সেই নিজেই গানটাকে দিলে ছেড়ে..! কি যুক্তি দেখাও..না শ্বশুর বাড়িতে আমাদের মতো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়দা,মেজদা মা, বাবার সামনে ছোট্ট মেয়ের মতো ঘরে বসে রেওয়াজ করাটা নাকি বিরাট এক সংকোচের কাজ….যদি অনভ্যাসে গাইতে গিয়ে সুর এলোমেলো হয়ে যায়… ভুল হয়ে যায় কোথাও…লজ্জার আর শেষ থাকবে না। তবুও বলেছি,বুঝিয়েছি কত! ঐ বলাই সার। এভাবে চুপ করে আছো..মা হয়তো অন্যরকম ভাবছেন..।’
‘ অন্যরকম..?’
অস্ফুটে বলে রিংকু।
‘ না কিছু না।’ কি একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় রিপন। চুপ করে থাকে।
রিংকু স্বামীর হাতখানা স্পর্শ করে।
‘বলছিলে না কী হয়েছে আমার? একটু বোসো।’
ডায়েরিটা বের করে এনে রিপনের হাতে তুলে দেয়। ‘ ‘ ‘ ‘মায়ের যত্নে রাখা আমার স্কুল জীবনের চিহ্ন।’
‘ আরে বাঃ! আগে দেখিনি তো!’
‘ শেষের দিকের একটা পাতা একটু খোলো। ছাপ্পান্ন নম্বর। আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। ‘
নির্দিষ্ট দাগের পৃষ্ঠাটা খোলামাত্র ভেতরকার অবাক ভাবটা যেন এক ধাক্কায় বেশ কিছুটা বেড়ে গেল রিপনের।
‘ কী এটা? মনে তো হচ্ছে রোজ্! ‘
ওর নজর চলে যায় পাশের পৃষ্ঠায় ছোট্ট কয়েক লাইনের লেখাটার দিকে।
তাকিয়ে থাকে রিংকু। দেখছে রিপনকে। ফুলের শুকনো মরা বৃন্ত দুটো নাকের কাছে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে কিসের যেন আঘ্রাণ নিচ্ছে রিপন।
‘মেমোরিস নেভার গন…!’
কথাগুলো অস্ফুটে বেরিয়ে আসে রিপনের মুখ থেকে। ওকে দেখতে দেখতে রিংকুর চোখ দুটো ক্রমশ ভেসে চলে সামনের খোলা জানলা দিয়ে দূরে.. বহুদূরে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন পুরনো ইস্কুলের বড় দরজার কাছে পৌঁছে যায় সে। সেই স্কুল মাঠ। পাতায় পাতায় হাওয়ার শনশন শব্দ। বকুল গাছের গায়ে লাগানো সিমেন্টের বেদিটাতে একলা বসে থাকে রিংকু। ভীষণভাবে একলা…!

রিপনের আলতো হাতের ছোঁয়া কখন যেন স্পর্শ করে ওকে,অজান্তেই। রিংকুর ভেজা আঁখিপল্লব তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
‘ জানো আজ মল্লিকা ফোন করেছিল। আমার সেই স্কুলের বান্ধবী। ডায়েরির পাতার ফাঁকে ফুলটা তখন সদ্য খুঁজে পেয়েছি। ওকে বলছিলাম…। কি আশ্চর্য দ্যাখো..সেদিন ওরা সবাই কত কেঁদেছিল! আমি কাঁদিনি। আজ আমি কাঁদি। কি জানি হয়তো প্রতিদিনই কাঁদি। ওরা ভুলে গেছে…। জীবন সত্যিসত্যিই কি অদ্ভুত তাই না!’
রিংকুকে জড়িয়ে ধরে রিপন। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরা জলগুলো মুছে দিচ্ছে..। দিতে দিতেই বলে,
‘ বাইরের আকাশটা দ্যাখো…গ্লুমি। কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়। সামনে আরো একটা দিন অপেক্ষা করে আছে। যেটা আবার আমি জানি। তুমি জানো না।’
‘ মানে?’
রিংকু বুঝতে পারে না রিপনের কথা।
‘ ফিউচার প্রেডিকশন। পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। এর বাইরে কি জীবনের কোনো ডাইমেনশন নেই? অবশ্যই আছে। রেমিনিসেন্স। একটা ছোট্ট শব্দ। অথচ কত কি উঠে আসে তাই না? ভ্যালুস বলো, প্যাথোস বলো,হ্যাপিনেস…। অ্যালবামেই রয়ে যায়। কিংবা ডায়েরির পাতায়। লাইক সাম কালারফুল রোজেস… যত ফেডেড হতে থাকবে,ততই তার ফ্র্যাগ্রান্স…। থাকুক না সেখানেই স্বযত্নে…।’
দিন কি শুধু ডায়েরির পাতাতেই বন্দী রয়ে যায় নাকি অ্যালবামে? গোলাপের সে গন্ধ আজও যে ভেসে বেড়ায় নিঃসঙ্গ হাওয়ায়…যে হাওয়ায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবে বলে প্রতিদিন ছুটে যেতে চেষ্টা করে রিংকুর লুকিয়ে থাকা মন…সে নিঃসঙ্গতা কতটুকুই বা বুঝবে রিপন..!

ভালো লাগছিল না রিংকুর…রিপনের এইভাবে জড়িয়ে ধরে থাকা…আঙুলগুলো নিয়ে ঠোঁটের কাছে খেলা করা..। সবসময় সবার মন ভালো থাকে না। এটা কেন যে রিপন বুঝতে চায় না মাঝেমাঝে!
রিংকুকে খানিক আদর টাদর করে খাটের পাশে রাখা নিজের ব্যাগটা থেকে কি যেন একটা খামে মোড়া কাগজ বের করে রিপন। হাসতে হাসতে কাগজটা মেলে ধরে রিংকুর চোখের সামনে…. ‘ভেবেই রেখেছিলাম, সকালে আসবো না। একেবারে বিকেলে রিপোর্টটা নিয়ে তবে… আমাদের নতুন অতিথি আসতে চলেছে। ইউ আর ক্যারিং রিংকু। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অব দ্য ডে….! ‘

ব্যাগ থেকে দুটো টুকটুকে লাল রংয়ের গোলাপের স্টিক বের করে রিংকুর দিকে এগিয়ে দেয় রিপন। চোখে মুখে একআকাশ উচ্ছ্বলতা।
‘ তা ম্যাডাম, একটু পরে আপনার হাতে অ্যালাচ সহযোগে বেশ কড়া করে এক কাপ কফি কি এই অধমের ভাগ্যে…?’
হঠাৎ আসা এলোমেলো হাওয়া…মনের অতলে জমে থাকা নিঃশ্বাসে অন্য কিসের প্রাণভরা আঘ্রাণ যেন….! আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে রিপনকে।

জানলার পাশে দেবদারু গাছের লতাপাতার ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে হঠাৎ আসা এক মুঠো রোদ্দুর মেঘের আস্তরণ সরিয়ে লুকোচুরি খেলছিলো…বেলা শেষের ছায়ার আড়ালে। স্কুলের বকুল গাছের ভেসে যাওয়া রৌদ্র- ছায়া কখন যে অজান্তে এসে বাসা বাঁধলো জন্ম থেকে দেখে আসা দেবদারু গাছটার ছোট্ট কোণে,কে জানে! এই বাসা বাঁধার খেলা হয়তো চলতেই থাকে। অনন্তকাল ধরে। জীবনের পরতে পরতে।। সমাপ্ত।

২৪পরগনা,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত

কবি আঞ্জুমান আরা খান

সকল পোস্ট : আঞ্জুমান আরা খান

মন্তব্য করুন