আমরা কি পারব না ফুটবলে আমাদের জয়রথ দেখতে?

স্পোর্টস ডেস্ক ১৪/০৭/২০২১ 

৫৩ বছর পর ইউরোর মুকুট নিজেদের করে নিল ইতালি আর ২৮ বছরের অভিশাপ কাটিয়ে কোপার শিরোপা ঘরে নিল আর্জেন্টিনা। সমগ্র বিশ্বের কথা জানি না, শুধু জানি আমরা এই দুইটি টুর্নামেন্ট নিয়ে কতটা উন্মাদ! হালের সন্তানেরা ইউরো নিয়ে কথা কাটাকাটি উল্লাস করলেও একসময় ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না আমরা। 

সালটা ২০০৮। বড় স্বপ্ন দেখিয়েই বাফুফে সভাপতির পদে বসেন কাজী সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিন বলেই তাঁর কাছে প্রত্যাশাও ছিল বেশি। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, সালাউদ্দিন যদি বাংলাদেশের ফুটবলকে উন্নতির সিঁড়িতে নিতে না পারেন তাহলে আর কেউই পারবেন না। দেশের ফুটবলের দায়িত্ব তাঁর হাতে উঠেছে দেখে তাই আশাবাদী হয়েছিলেন ফুটবল-সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই। বাফুফেতে সালাউদ্দিন সহযোগী হিসেবেও পেয়েছিলেন সাবেক তারকাদেরই। তবু অপ্রিয় সত্যি হলো, বাফুফে সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের এক যুগের ইতিহাস নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। এই ১২ বছরে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই নিচের দিকে নেমেছে। যে সাফ অঞ্চলে একটা ভালো অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের গর্ব ছিল, সেটিও আজ অতীত। ভাবা যায়, সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হওয়ার পর ৬টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা বাংলাদেশ গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে ৫ বারই! ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নামতে নামতে বাংলাদেশ এখন ১৮৭। একটা সময় তো এই অবস্থান ১৯৭-এ গিয়েও ঠেকেছিল!

অথচ কী ছিল সেই স্বপ্নের কথা? ২০২২ সালের বিশ্বকাপ খেলব আমরা। বিশ্বাস করি, মাটিতে পা না রেখেই প্রতিটি বাঙালি হৃদয় স্বপ্ন দেখেছিল কাজী সালাউদ্দিন ক্যারিশমাটিক কিছু করে দেখাবেন। ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে হয়তো এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে ফেলতে পারতাম, যেমনটি পেরেছে ভারত। ক্লাব ফুটবল, লীগ ফুটবল, ডিভিশনাল ফুটবল আর জেলা ফুটবল নিয়ে আলাদা আলাদা করে ভাবলে অসম্ভব কিছু নয়। একসময় কাছাকাছি র‍্যাংকিং নিয়ে অবস্থান করা ভারতের র‍্যাংকিং এখন সমীহ করার মতো। ২০১৪ সালের ১৭৪ নম্বর র‍্যাংকিং দলটির র‍্যাংকিং এখন ১০২! অথচ একসময় ভারতীয় জাতীয় দলকে বলে কয়ে হারাতো বাংলাদেশ!

ভারতের মূলত এই উন্নতি ঘটে ইংলিশ কোচ স্টিফেন কনস্ট্যানটাইনের আমলে।

এরপর ইউক্রেনিয়ান কোচ ইগর স্টিম্যাচ এখন ভারতের দায়িত্বে আছেন।

বিদেশি কোচদের প্রভাব একটা বড় ব্যাপার বলে মনে করেন, কলকাতা ভিত্তিক একজন ক্রীড়া সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তী।

তিনি বলেন, “ভারতের ফুটবলে উত্থানের পেছনে বিশেষ কারণ ভারতের দলটিতে বিদেশী কোচদের আবির্ভাব, তারা দলের প্রতি বেশ নিয়োজিত ছিলেন। দলের জন্য কাজ করেছেন ভেবেছেন কিভাবে কি করলে ফল আসবে।”

অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের আলাদাভাবে লীগ নিয়ে কাজ করার কথাও বলেছেন মি: চক্রবর্তী।

“বিভিন্ন ক্লাব আইএসএলে বিদেশী খেলোয়াড়রা আসেন যারা বিশ্বকাপ খেলেছেন। এই যে ভারতীয় দলের খেলোয়াড়রা আই লীগের দলে খেলেন না, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন চেষ্টা করে গিয়েছে।”

ভারতের ফুটবল ফেডারেশন একদম ছোট বয়স থেকে ফুটবলার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে।

জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, “একদম মিল্কটিথ বয়স থেকে অর্থাৎ দুধের শিশুকে এই প্রক্রিয়ায় আনা হয়, তাকে গড়ে তোলা হয় একজন ফুটবলার হিসেবে যাতে সে ফুটবলকে ধ্যানজ্ঞান করে বেড়ে ওঠে।”

একটা বেশ চমকপ্রদ ব্যাপারও লক্ষ্য করা গিয়েছে যে ভারতের দলটিতে পার্বত্য অঞ্চলের খেলোয়াড় বেশি।

জয়ন্ত চক্রবর্তীর মতে, পার্বত্য অঞ্চলের ছেলেদের প্রাধাণ্য দেয়া হয়েছে তাদের কর্মক্ষমতা বেশি এই কারণে। তারা বেশি সময় কাজ করতে পারে ভৌগলিক কারণে।

ভারতের মতো বড় দেশের বিভিন্ন পর্যায় ফুটবলার উঠিয়ে আনার জন্য তারা ফুটবল একাডেমি তৈরি করেছে।

এটাকে একটা বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের জাতীয় দলের কোচিং করানো মারুফুল হক।

“ভারতের অনেকগুলো একাডেমি আছে, ফুটবলার অনুশীলন ও প্রযোজনা করার জন্য তারা কাজ করে থাকে।”

ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও তাদের শহরগুলোতে পৃথক ফুটবল একাডেমি গড়ে ওঠার কারণে ফুটবল সংস্কৃতি একটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে গোটা দেশজুড়ে।

ভারতে ইন্ডিয়ান লীগ ও ইন্ডিয়ান সুপার লীগ অর্থাৎ দুটি প্রতিযোগিতা হয় যেখানে ভারতের ফুটবলারদের সাথে বিশ্বের নানা দেশ থেকে তরুণ ও একটু বয়স্ক আন্তর্জাতিক ফুটবলারদের নিয়ে আসা হয়।

যেখানে ফ্রান্সের ডেভিড ত্রেজেগে, ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোস, ইতালির আলেজান্দ্রো দেল পিয়েরোর মতো ফুটবলাররা খেলেছেন।

মারুফুল হক বলেন, “আইএসএল ও আইলিগে বিশ্বমানের ফুটবলাররা আসেন, ভারতের লোকাল প্লেয়াররা যখন তাদের সাথে খেলে অনেক কিছু শিখতে পারে, প্রতিযোগিতাও বেশ জোরদার হয় সেখানে।”

ভারতের ফুটবলের মান ও ফেডারেশনের প্রচেষ্টার কারণে জোনাল খেলা জয়, মোহনবাগান, চেন্নাই এমন প্রত্যেক অঞ্চলে ভালো দল আছে ফলে তাদের নিয়ে মাতামাতি হয় এবং যারা ফুটবল ভালোবাসে তারা খেলায় প্রতিযোগিতা অনুভব করে বলে মনে করেন মারুফুল হক।

বাংলাদেশের যুবক-বৃদ্ধরা যখন ভিনদেশী ফুটবল নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে, তখন তাদের হৃদয়ের অতৃপ্ত বাসনা কি একটু হলেও কষ্ট দেয় না? লাল-সবুজের পতাকা উঁচিয়ে উল্লাস করার চেয়ে গর্বের আর কিছুই হতে পারে না। প্রিয় বাফুফে সভাপতি, আপনি চাইলেই পারবেন কোটি যুবার স্বপ্নপূরণের কাণ্ডারী হয়ে উঠতে; শুধু চাই স্বদিচ্ছা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা। আমরা জামাল ভূইয়াদের জার্সি পরে বুক ফুলিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের জয়ধ্বনি করতে চাই। আমরা স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের ফুটবল ক্রেজ আবার ফিরেছে আবাহনী মোহামেডানে, শূন্য গ্যালারি আবার ভরে উঠেছে, ভিনদেশীরাও স্বপ্নের নায়ক বানিয়ে ঘরে টানিয়ে রাখছে জামালদের পোস্টার।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়

মন্তব্য করুন