আমার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর > ০১ : শিল্পী যখন ঐতিহাসিক বেঈমান/লুৎফর রহমান রিটন


লুৎফর রহমান রিটন

বদমাশ সব সেক্টরেই থাকে। লেখক-কবি-শিল্পীদের মধ্যেও থাকে।
বেঈমান সব সেক্টরেই থাকে। লেখক-কবি-শিল্পীদের মধ্যেও থাকে।
বিশ্বাসঘাতক সব সেক্টরেই থাকে। লেখক-কবি-শিল্পীদের মধ্যেও থাকে।

একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি গানটা গেয়েছিলেন আপেল মাহমুদ নামের তরুণ এক শিল্পী। খুবই নগন্য সংখ্যক বাদ্য-বাজনার ব্যবহারে অসাধারণ কথা আর সুরে নির্মিত গানটা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করতো বিপুলভাবে। ক্যাম্পে-রণাঙ্গণে তাঁরা গুণগুণিয়ে গাইতেন এই গানটা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতারে একজন উর্ধতন কর্মকর্তার আসন অলংকৃত করানো হয়েছিলো আপেল মাহমুদকে দিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র পৌনে চার বছরের মাথায় এই আপেল মাহমুদের ভেতরকার হিংস্র হায়েনাটা বেরিয়ে এসেছিলো ধারালো নখর-দন্তসমেত। যে ফুল বাঁচানোর গান গেয়ে সে বিখ্যাত হয়েছিলো, সেই সেই ফুল বাগানের স্বপ্নদ্রষ্টা বা নির্মাতাকে হত্যাপ্রক্রিয়ার অংশী হয়েছিলো এই কুলাঙ্গার।
খালেদা জিয়া এবং এরশাদের শাসনামলে তরতর করে প্রমোশন হয়েছে তার। খালেদা জিয়া তাকে পুরস্কার হিশেবে একবার প্রমোশন দিয়ে উচ্চাসনে বসিয়ে দুই দুইবার এক্সটেনশন দিয়েছেন।
শাহবাগের বেতার ভবনের নিচতলায় একটি বড়সড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসতো আপেল মাহমুদ। দরোজার কাচের খোঁপগুলোয়(ফ্রেম)রঙ এবং কাগজ সাঁটিয়ে সে তার কক্ষটিকে মানুষের দৃষ্টিসীমানার আড়ালে রাখতো। তাঁর নারীলিপ্সার কুৎসীত কীর্তিগুলো খুব আলোচিত ছিলো বেতার ভবনে। বিশেষ বিশেষ সময়ে কক্ষটির দরোজা বন্ধ থাকতো ভেতর থেকে। সহকর্মী-পিওন-দারোয়ানদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো কাহিনিগুলো। প্রতিদিন অফিস থেকে চলে যাবার সময় আপেল মাহমুদ তার কক্ষের দরোজাটিকে তালাবদ্ধ করতো।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে জাতিরজনককে সপরিবারে হত্যার পর খুব ভোর বেলাতেই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা শাহবাগে এসেছিলো বেতার ভবনের দখল নিতে। মেজর ডালিমসহ ঘাতকদের কয়েকজন কয়েক ঘন্টা আগের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে বেতার ভবনে আসবে সেটা আপেল মাহমুদ জানতো। প্রতিদিন অফিস থেকে চলে যাবার সময় সে তার কক্ষটি তালাবদ্ধ করে গেলেও ১৪ আগস্ট বিকেলে সেটা করেনি। সেদিন দরোজাটা ভেজিয়ে রেখেছিলো সে। কারণ পরদিন ভোর বেলায় বেতার ঘোষণার আগে এবং পরে ঘাতকরা তার কক্ষেই এসে বসবে।
”শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে…” একটু পর পর বারবার এরকম ভয়াবহ এবং অবিশ্বাস্য ঘোষণাটা সেদিন বিষণ্ণ সকালে সারা বাংলাদেশের বিহবল মানুষেরা জানতে পেরেছিলেন সরকার কবির উদ্দিনের কণ্ঠে! খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ঘটনাটা ঘটেছে সেটাও বলা হচ্ছিলো ঘোষণায়। কিছুক্ষণ পর রেডিওতে শোনা গিয়েছিলো কুলাঙ্গার ডালিমের সদম্ভ ঘোষণা। সেই ঘোষণায় জাতিকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার মতো শীতল থ্রেটও ছিলো।
১৫ই আগস্টের সেই ভয়ংকর সকালেই উৎফুল্ল আপেল মাহমুদ এসে তার কক্ষে অবস্থান করা খুনিদের সেবায় নিয়োজিত হয়েছিলো। খুনিরা পুরো বেতার ভবনটি নিজেদের কব্জায় নেয়ার কাজটি সম্পন্ন করে পরবর্তী নির্দেশনা দিয়ে অনুচরদের দায়িত্বে রেখে সকালের ব্রেকফাস্ট করতে গিয়েছিলো কবি তালিম হোসেন ও মাফরুহা চৌধুরীর কন্যা নজরুল গীতির বিখ্যাত শিল্পী শবনম মুশতারির বাসায়। এটাও পূর্ব নির্ধারিত ছিলো।
সেই সকালেই বেতারের সকল শ্রেণির কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের জানা হয়ে গিয়েছিলো খুনিদের সঙ্গে আপেল মাহমুদের সংশ্লিষ্টতা এবং মাখামাখির সম্পর্কটি। সবাই তাকে ভয় পেতে শুরু করেছিলো। সেই সকাল থেকেই এরকম অবিশ্বাস্য আভাবনীয় হত্যাকাণ্ডের পর হাস্যোজ্জ্বল এবং উৎফুল্ল আপেল মাহমুদকে দেখে ভীতি সঞ্চারিত হয়েছিলো পুরো বেতার ভবনজুড়ে।
সেই সকালে বেতার ভবনে এনাউন্সার হিশেবে দায়িত্বরত ছিলেন অভিনয় শিল্পী আফরোজা বানু। বেতার ভবনে প্রবেশের আগে, তিনি তখনো জানতেন না জাতিরপিতার হত্যাকাণ্ডের নির্মম কাহিনি। ডিউটিতে এসে আফরোজা বানু হতবাক এবং বিপন্ন বোধ করছিলেন।
কয়েক বছর আগে কানাডায় আফরোজা বানু তাঁর স্বামী (বেতারের আরেক এনাউন্সার) মহসিন রেজাসহ পুত্রের সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে এলে আমি একদিন বিস্তারিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম তাঁর। তিনি আমাকে সেদিন সকালে দেখা পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন।
তিনি ছাড়াও আরো কয়েকজন বেতারকর্মীর অভিজ্ঞতায় একই রকম বর্ণনা আমি পেয়েছি।
সেই সকালেই বেতার ভবনে এসেছিলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক অভিনেতা এবং সঙ্গীত পরিচালক খান আতাউর রহমান। তিনিও অবস্থান নিয়েছিলেন আপেল মাহমুদের কক্ষেই। সেই কক্ষে বসেই তিনি গান লিখছিলেন আর সুর করছিলেন আপেল মাহমুদের আতিথ্যে, চা-বিস্কুট খেতে খেতে। খান আতার জন্যে একটা হারমোনিয়াম আগেই আনিয়ে রেখেছিলো আপেল মাহমুদ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে খান আতা যে গানটা লিখেছিলেন এবং তাৎক্ষণিক সুর সংযোজন করে শিল্পীদের কণ্ঠে তুলে দিয়েছিলেন সেই গানটা ছিলো এরকম–(স্মৃতি থেকে লিখছি, তবে খুব সামান্যই ফেরফের হতে পারে)–
কোরাস পুরুষকণ্ঠ বলছে–আমরা এদেশ স্বাধীন করেছিলাম/ কাহাদের জন্য কাহাদের জন্য কাহাদের জন্য?
জবাবে একটি নারী কণ্ঠ জিজ্ঞেস করছে–মুষ্টিমেয় ঐ দুর্নীতিপরায়ণ নিষ্ঠুর হায়েনার জন্য?
কোরাসপুরুষ–না না না না মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে কথা/ মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা
একটি পুরুষকণ্ঠ–আবার প্রশ্ন করো জনতার কাছে…
জবাবে কোরাস নারীকণ্ঠ–আমরা আমরা আমরা/আমাদের জন্য আমাদের জন্য/ আমরা আমরা আমরা…
একটি পুরুষকণ্ঠ–তোমরা কারা?/ তোমরা কি বাংলার নিপীড়িত মানুষের জনতা?
সমবেত কণ্ঠ–আমরা শ্রমিক আমরা কিষাণ/ মেহনতী মানুষের জনতা/পরাধীন জীবনে শাসন আর শোষণে রিক্ত যারা/রিক্ত যারা/ অন্যায় অবিচার সইছে যারা/সইছে যারা/বাংলার স্বাধীনতা আমাদের নয়তো কাহাদের কাহাদের কাহাদের?/বলো কাহাদের?/ বলো কাহাদের?…।
সমবেত পুরুষকণ্ঠ–সত্যভাষণ হে বাংলার জনতা/স্বাধীনতা তোমাদের তোমাদের তোমাদের…
কোরাস নারীকণ্ঠ–পরাধীন জীবন যে কতো/ অনাহার আর যন্ত্রণা/যাদের রক্তে…. …/তোমরা যারা বুকের রক্ত দিয়েছিলে/ জীবন দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলে/ তোমাদের সেই আত্মত্যাগের মহিমাকে ধুলায় লুটালো কারা?/হায়রে ধুলায় লুটালো কারা?/হায় রে ধুলায় লুটালো কারা…
কোরাস পুরুষকণ্ঠ–এই কি ছিলো সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য?/এই কি ছিলো সেই মুক্তিযুদ্ধের কাম্য?/ এই কি বাংলার সাম্য?/এই কি বাংলার সাম্য?/ এই কি বাংলার সাম্য?…
সমবেত কণ্ঠ–না না না না নাহ্‌ নাহ নাহ্‌ নাহ্‌/ আমরা বাংলাকে স্বাধীন করেছিলাম সাধারণ মানুষের জন্য/নিপীড়িত জনতার জন্য/ নিপীড়িত জনতার জন্য/ নিপীড়িত জনতার জন্য…।
১৫ই আগস্টের সেই বিপন্ন আর বিষণ্ণ সকালে বারবার প্রচারিত হচ্ছিলো গানটি। খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে বারবার। গানের বাণী তাই আমার স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছিলো।
১৫ই আগস্টের পর বেতার ভবনে আপেল মাহমুদ ছিলো সবচে দাপুটে কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন সে চাকরি করেছে দাপটের সঙ্গে। ক্ষমতার অদল বদল হলেও তার কিছুই হয়নি বলতে গেলে। তাকে দাঁড়াতে হয়নি কাঠগড়ায়। বিচারের মুখোমুখি করানো হয়নি তাকে। বিস্মরণপ্রিয় জাতি বাঙালি ভুলেই গিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে তার পূর্বাহ্নের ও পরবর্তীর সংশ্লিষ্টতা।
কিন্তু ধিরে ধিরে উঠে এসেছিলো আপেল মাহমুদের কুকীর্তিসমূহ। বেতারে চুক্তিভিত্তিক কাজ করা খালেক বিন জয়েনউদ্দিন দৈনিক জনকণ্ঠে লিখেছিলেন একটি নাতিদীর্ঘ রচনা।
আইনি বিচারের মুখোমুখি না হলেও প্রকৃতির বিচার সংগঠিত হয়েছে কিছুটা। স্বাধীন বাংলা বেতারে গাওয়া এই কুলাঙ্গারের—‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ কিংবা ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে’ শীর্ষক গান দু’টো স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আয়োজনে বাজানো হলেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ অধিষ্ঠিত হবার পর গণরোষের ভয়ে সে আর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে বা আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে আসেনি। একটা ঘৃণ্য কীটের মতোই সে বেঁচে আছে। তার এই যাপিত জীবনও এক ধরণের শাস্তিই।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের নানা আয়োজনে তার তো থাকার কথা সমুখ সারিতে, মঞ্চে!
কিন্তু কোথাও যেতে পারে না এই কুলাঙ্গার।
বেঈমান সব সেক্টরেই থাকে। লেখক-কবি-শিল্পীদের মধ্যেও থাকে।
আপেল মাহমুদ সেই বেঈমানের প্রতিকৃতি হয়েই বেঁচে আছে।
বিশ্বাসঘাতক সব সেক্টরেই থাকে। লেখক-কবি-শিল্পীদের মধ্যেও থাকে।
আপেল মাহমুদ সেই বিশ্বাসঘাতকের প্রতিমূর্তি হয়েই বেঁচে আছে।
আমার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের প্রথম লেখাটির মাধ্যমে আমি আমার সর্বোচ্চ ঘৃণা প্রকাশ করছি বর্তমানে সিডনি নিবাসী এই কুলাঙ্গারের প্রতি।
অটোয়া ০৬ মার্চ ২০২১

অটোয়া ০৬ মার্চ ২০২১

নাআকা/আজ আগামী ডেস্ক/৭মার্চ/২০২১

মন্তব্য করুন