ক্ষুদিরাম বসুঃ অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ// অলোক আচার্য



চিনতে নাকি সোনার ছেলে/ ক্ষুদিরাম কে চিনতে?/ রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিল যে/ মুক্ত বাতাস কিনতে- কবি আল মাহমুদের মুক্ত বাতাস কিনতে প্রাণ দেওয়া এই সোনার ছেলের নাম ক্ষুদিরাম বসু। প্রায় দুইশ বছর শাসন করা ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পেতে আন্দোলন সংগ্রামে যারা অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন, যারা অস্ত্র হাতে অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে সে তালিকাও দীর্ঘ। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নাম হলো শহীদ ক্ষুদীরাম বসু। একটি কিশোর যার স্বপ্নে ছিল স্বদেশকে মুক্ত করা, যার হৃদয়জুড়ে ছিল দেশমাতৃকা। যাকে নির্মমভাবে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সেই কিশোর যে এই অখন্ড ভারতবর্ষের অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ। এই সাহসী কিশোর তার সম্ভাব্য পরিণতি জানতো। কিন্তু দুঃখ,কষ্ট- বিপদ-আপদ এবং মৃত্যু বরণ করতে হবে জেনেও এই কিশোর কখনোই দেশকে মুক্ত করতে পিছপা হননি। মুক্ত হাওয়া, মুক্ত পরিবেশ এবং বাধাহীন শৈশবে বেড়ে ওঠার সাথে আত্নপরিচয়ে বাঁচতে শেখার নাম স্বাধীনতা। বাংলার ইতিহাসে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে বাংলার স্বাধীনতা ব্রিটিশের হাতে চলে যায়। সেখান থেকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে প্রাণ দিয়েছেন বহু দেশপ্রেমিক। ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর ১৯০৮ সালের ১২ আগষ্ট অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত শেষ সময়ের বর্ণনায় জানা যায়, ’মজঃফরপুর, ১১ আগষ্ট অদ্য ভোর ছয় ঘটিকার সময় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হইয়া গিয়াছে। ক্ষুদিরাম দৃঢ় পদক্ষেপে প্রফুল্ল চিত্তে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়। এমন কি তাহার মাথার ওর যখন টুপি টানিয়া দেওয়া হইল, তখনও সে হাসিতে ছিল। স্বদেশের জন্য মৃত্যুকে কিভাবে হাসিমুখে বরণ করতে হয় তা শিখিয়েছিল ক্ষুদিরাম বসু। আঠারো বছর বয়স যে কি সাহসী হয় তারও প্রমাণ ক্ষুদিরামের দৃঢ় মনেবলে। তার স্মরণে রচিত বিখ্যাত গান, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি- আজ মানুষের অন্তরে প্রবাহিত। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ক্ষুদিরাম আজও আছে এই বাংলায়। প্রতিটি সাহসী দেশপ্রেমিক কিশোরই আজ একজন ক্ষুদিরাম।
আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ব্রিটিশ এবং পরবর্তীতে পাকিস্থানীদের হাত থেকে স্বাধীন হতে বহু জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। যুগে যুগে এসেছে বীর নারী-পুরুষ। যারা স্বাধীনাতর স্বপ্ন দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন। পৃথিবীতে যুগে যুগে দেশের জন্য বুকের রক্ত বিলিয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেশ পাকিস্থানীদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার আগে অর্থ্যাৎ দেশভাগের আগে ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তখন ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য বহু আন্দেলানকারী ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে আন্দোলন করেছেন। কিশোর,যুবা,নারী,পুরম্নষ নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলন করেছেন। মাষ্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,শহীদ তিতুমীর আরও অনেক বিপ্লবী জন্মেছেন এবং ব্রিটিশদের রায়ে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি পরেছেন। ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম ১৮৮৯ সালে খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মেদেনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে। পিতা ত্রৈলক্যনাথ বসু এবং মাতা লক্ষিপ্রিয়া দেবী। ক্ষুদিরাম নামকরণের পেছনেও রয়েছে ছোট্র ইতিহাস। তিন কন্যা সন্তান জন্মের পর তিনি ছিলেন চতুর্থ সন্তান। তার আগেই দুই পুত্র জন্মের পর মারা গিয়েছিল বলে জন্মের পরই তিন মুঠো ক্ষুদের বিনিময়ে তাকে তার দিদির কাছে দেন। এর থেকে তার নাম হয় ক্ষুদিরাম। ১৮৯৫ সালে তার মা-বাবা মৃত্যুবরণ করলে তার বড় বোন অপরুপা তাকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেন। তার ভেতরে স্বদেশের চেতনা জন্ম নিতে সময় নেয়নি। ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে মেদেনীপুরের এক কৃষি ও শিল্পমেলায় বিপ্লবী পত্রিকা ’সোনার বাংলা বিলি করার সময় ক্ষুদিরাম প্রথমে পুলিশের হাতে ধরা পরেন কিন্তু পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন। এরপর থেকে ক্ষুদিরাম বসু ক্রমেই ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন কাজে অংশ নেন। স্বদেশি আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার জন্য তার জামাইবাবুর সরকারি চাকরিতে অসুবিধা হলে তাকে আশ্রয় দেন মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়েজেদের বোন। এ সময় কিংসফোর্ড নামটি ছিল বাঙালিদের কাছে ঘৃণার।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে, কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্টেট কিংসফোর্ড ঘৃনার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। সেই দিনটি ছিল ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট। বাংলার এক সাহসী দেশপ্রেমিককে হারিয়েছিল ভারতবাসী। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিহারের মুজাফফরপুর ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে হত্যা করতে গিয়েছিলেন সেই অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে। তার সাথে ছিলেন বিপস্নবী প্রফুল্ল চাকী। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। যে গাড়িটিতে তাদের থাকার কথা ছিল তারা ছিলেন না সেদিন। তার বদলে মারা যায় দুই ইংরেজ মহিলার। দুই বিপ্লবী নিজের রাস্তায় পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গী বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী ধরা পরে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে থাকা রিভলবার দিয়ে আত্নহত্যা করেন। কিন্তু ব্রিটিশদের হাতে ধরা পরেন ক্ষুদিরাম বসু। বিচারে তার ফাঁসির রায় দেন বিচারক মি. কর্নডফ। তিনি ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞ্যেস করেছিলেন ফাঁসিতে যে মরতে হবে সেটা বুঝেছো? জবাবে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, বুঝেছি। তার মুখের অবিচলিত হাসি হাসি ভাব দেখেই বিচারক প্রশ্নটি করেছিলেন। এ নিয়ে ১৮ জুন সঞ্জিবনীতে লেখা হয়, ’মৃত্যুদন্ডাজ্ঞার পর ক্ষুদিরামকে সম্পূর্ণ অবিচলিত দেখিয়া এবং তাহার নির্বকার ভাব লড়্গ্য করিয়া বিদেশী রাজার স্বজাতীয় বিচারকের মনে সম্ভবতঃ এইরুপ ধারণা জন্মিয়াছিল যে, আসামীর প্রতি যে চরমদন্ড প্রদত্ত হইয়াছে তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। এই ধারণাতে বিচারক ক্ষুদিরামকে উক্ত প্রশ্নটি করেছিলেন। মৃত্যুকে যে জীবনের সাথে মিলিয়ে নিয়েছে তার কাছে মৃত্যু আর জীবনের মাঝে কোনো বিভেদ নেই সেকথা তখন বিচারকও বুঝতে অক্ষম ছিল। মৃত্যু যে কত সহজে বরণ করে নেওয়া যায় তা শিখিয়ে গেছে ক্ষুদিরাম। ফাঁসির আগে শেষ ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়। ক্ষুদিরামের কাছেও জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে ক্ষুদিরাম বলেছিল, তিনি বোমা বানাতে জানেন। ব্রিটিশদের অনুমতি পেলে তিনি তার বোমা বানানোর বিদ্যা ভারতবাসীকে শিখিয়ে যেতে চান। কি অসীম সাহস থাকলে মৃত্যুকূপে দাড়িয়েও দেশের কথা ভাবা যায়, মানুষের মুক্তির কথা চিন্তা করা যায় তার উদাহরণ ক্ষুদিরাম বসু।


কবি অলোক আচার্য

সকল পোস্ট : অলোক আচার্য