টুকরো স্মৃতির গল্প [৫]

দেশের দক্ষিণ জনপদ মঠবাড়িয়া থানার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। তদানীন্তন বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়া থানা শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে আজ পর্যন্ত। আমার জন্ম গর্বিত সেই জনপদে; যেখানে জন্ম নিয়েছেন কবি আবদুল খালেক, নাট্যব্যক্তিত্ব শংকর সাওজাল, কণ্ঠশিল্পী সতীন্দ্রনাথ হালদার, কবি ও গীতিকার আলমগীর কবির আবু, সঙ্গীত গুরু বাসুদেব মিত্র, সঙ্গীত গুরু বাশীরাম শীল, ধলু মজুমদারসহ আরও অনেকে। বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও শিল্পীদের অনেকেরেই জন্মভূমি মঠবাড়িয়ায়। তাদের কেউ কেউ আমার বাল্যসাথী, কেউ কেউ স্নেহধন্য ছোটভাই। জন্মের পর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠিছি আমি। আজ আমার অতি ক্ষুদ্র পরিচিতির জন্য আমার জন্মস্থান ও সেখানকার মানুষের প্রতি ঋণ স্বীকার করি। পাকিস্তান আমল থেকে মঠবাড়িয়ায় ড্রামাটিক ক্লাবটির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা হলেন : বনবিহারী বণিক (কাঁসা-পিতলের দোকান), কালু দাস (এখনও ব্যাংকপাড়ার পিছনে বিশাল বাগানটি কালু দাসের বাগান নামে পরিচিত), নিত্য কুণ্ড (মিষ্টির দোকান), বিশাল পেট নিয়ে মিষ্টির দোকানে কখনো কখনো খালি গায়ে বসে থাকতে দেখেছি তাকে। মঠবাড়িয়া ড্রামাটিক ক্লাবের নাটক হলে তিনি রাজার পাঠ করতেন। ডাক্তার মতিয়ার রহমান (তিনি মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন), ডা: মতিয়ার রহমান চাচা স্বাধীনতার পর একটি ভ্যাসপা চালাতেন। মঠাাড়িয়ায় প্রথম মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছেন মোশাররফ হোসেন, তার ৫০ সিসির একটি হোড্ডা ছিল। ডা: মতিয়ার রহমান চাচার মঠবাড়িয়ায় ওষুধের দোকানে তার একটি ছোট টিভি ছিল। তখনও মঠবাড়িয়ায় বিদ্যুৎ আসেনি। বেটারি দিয়ে টিভি চালাতেন তিনি। সাপ্তাহিক নাটকের দিনে দোকানে টিভি দেখতে যেতেন তার বড় মেয়ে কণ্ঠশিল্পী ডা: রওশন আপা (তিনি সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারের হোসেনের সহধর্মিনী), মেজো মেয়ে কাজল (ক্লাস ফাইভে আমার শ্রেণিবন্ধু), তার ছোট বোন এমিলি ও সোনালী। এমিলি বেশ কয়েক বছর আগে প্রায়াত হয়েছে। মতিয়ার রহমান চাচার ছোট ছেলে ডা: জাকির হোসেন মন্টুর (বর্তমানে এডিশনাল সেক্রেটারি) সঙ্গে খালাম্মা অর্থ রওশন আপাদের মাও যেতেন টিভি দেখতে। আমি তখনও টিভি দেখিনি। যেতে সাহস করতাম না। রাস্তার চলতি পথে একটু উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম।ডাক্তার মতিয়ার রহমান ছিলেন আমার দাদীর পছন্দের ডাক্তার। দাদী মঠবাড়িয়া এলে মতিয়ার রহমান চাচা ছাড়া কাউকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে পছন্দ করতেন না। একদিন তিনি আসরের নামাজ পড়ে ডাক্তার মহসিনকে ডেকে বললেন, ‘নাতি আসো স্যালাইনটা লাগিয়ে দাও।’ স্যালাইন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে দাদী মারা গেলেন! মহসিন ভাই ছিলেন উপজেলা ৫০-বেড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। তিনি আমার বড় ভাই মেজবা উদ্দিনের বাবুলের বন্ধু। মহসিন ভাইর এক বোন ক্লাস ফাইভে আমার শ্রেণিবন্ধু ছিল। তার বাবার নাম খলিলুর রহমান। ব্যাংকপাড়ার খালের ওপারে জালাল ভাইদের বাসার সঙ্গে ছিল তাদের বাসা। জালাল ভাই ছোট বোন সুরমা ও সেলিম উদীচী করত। সুরমা একবার টিটিডিসির অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় ওর সঙ্গে আমাকে তবলা বাজাতে বলেছিল, এতে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। সুরমা কিছুটা তালকানা ছিলো। উদীচীতে বসে তাল কেটে গেলে কৌশলে বুঝতে দিতাম না আমি। এ জন্য ও আমার তবলা বাদন পছন্দ করত। তবে সেদিনও সে তাল কেটেছিল ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ গানটি গাইতে গাইতে। ড্রামাটিক ক্লাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন কো-অপারেটিভ ব্যংকের ম্যানেজার আবদুল জব্বার। তিনি আমার চাচা হন। বাবার চাচাতো ভাই ছিলেন তিনি। ব্যাংকপাড়ায় আমরা পাশাপাশি বাসায় থাকতাম। জব্বার চাচার ছেলে সফিকুর রহমান তকদির, মিজানুর রহমান তসলিম, তসরিফ, খুকু ও পপির বাবা ছিলেন জব্বার চাচা। এরা সবাই গানবাজনা করতো। বর্তমানে মিজানুর রহমান তসলিম বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। আমরা দুজনে একই ক্লাসে পড়তাম। তসলিম এক সময় হাতে লিখে পত্রিকা বের করত। ওর হাতের লেখা ছিল চমৎকার। ওর পত্রিকার জন্য আমাকে দিয়ে অনেক ছড়া লিখিয়ে নিতো তসলিম। ওর সাথে যেমন বন্ধুত্ব ছিল, তেমনি খুনসুটিও কম ছিল না। এরা সবাই উদীচীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ড্রামাটিক ক্লাবের সঙ্গে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বাসুদেব মিত্র ও বাশীরাম শিল ও ধলু দা যুক্ত ছিলেন। বাশীরাম শীল পরবর্তীতে আমার সঙ্গীত গুরু ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইন্ডিয়া চলে গেলে সেখানে সে অন্ধ হয়ে যায়।ড্রামাটিক ক্লাসের সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন কিসলু ভাই, তিনি বেহালা ও বেঞ্জু বাজাতেন, উদীচী করতেন। এ ছাড়াও সাধন কর্মকার (রেডিও মেকানিক্স)-এর বাবা ছিলেন নারায়ণ সাধু। তিনি এস্রাজ বাজাতেন। ১৯৭৫ সালে রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু সপরিবারের নিহত হলে সেই দুঃশাসনের দিনে নারায়ণ কর্মকার মহাফ্যাসাদের পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি ঠোঙ্গা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতেন। হঠাৎ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের পাতা দিয়ে ঠোঙ্গা বানিয়েছেন! বিচার সভা বসলো। বিচার সভার প্রধান হলেন প্রফেসর জালাল ভাই ও ঠান্ডা আপুর বাবা খালেক মাস্টার; তার জুতার দোকান ছিল। আমার বাবা তাকে শ্বশুর বলে ডাকতেন। আমার বাবার শ্বশুরবাড়ি ভাণ্ডারিয়ার মিয়া বাড়ি। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন আমার মায়ের জ্যেষ্ঠ চাচাতো ভাই। খালেক মাস্টারের বাড়িও ভাণ্ডারিয়ায়। বিচার সভার কাজ শুরু হলে তখনকার দিনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয়রা উপস্থিত থাকলেও কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। কিচলু ভাই বিচার সভার একজন ছিলেন। এ জন্য শংকার দা তাকে আগেই নারায়ণ সাধুর ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলেছিলেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। খালেক মাস্টার নারায়ণ সাধুকে বললেন, আপনি কি অন্যায় স্বীকার করেন? নারায়ন সাধু বললেন, করি। -তাহলে তো ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী আপনার বিচার হবে।-বিচার মাথা পেতে নেবো আমি।নির্ভীক অকুতোভয় নারায়ণ সাধুর এতোটুকু ভয় নেই। তিনি বিচার মাথা পেতে নেবেন। কিচলু ভাই বললেন, নারায়ণ দা তো কোরআন শরিফ বিক্রি করেন না। তাছাড়া তিনি আরবী পড়তেও পারেন না। তিনি কোরআনের পাতা কই পেলেন, এটা আমাদের জানা উচিত।নারায়ণ সাধু বললেন, তিনি পুরোনো কাগজপত্র হাশেম ডাক্তারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। হাশেম ডাক্তারের ইসলামী বইপত্র বিক্রি দোকান ছিল মঠবাড়িয়া বাজারে।বিজ্ঞ বিচারক খালেক মাস্টার বানানো ঠোঙ্গাটি নেড়েচেড়ে দেখলেন এক পাশে লেখা রয়েছে : পান দুই আনা, সুপারি দুই আনা। চা পাতা চার আনা…’ খালেক মাস্টার বললেন, এসব বাজারের ফর্দ কার লেখা? নারায়ণ সাধু বললেন, জানি না; তবে এ লেখা আমার নয়। খালেক মাস্টারের সন্দেহ হলে তিনি হাশেম ডাক্তারের দোকান থেকে টালিখাতা এনে মিলিয়ে দেখলেন কোরআন শরীফের পাতায় লেখা হাশেম ডাক্তারের। বিজ্ঞ বিচারক বললেন, যে মুসলমান তার নিজের গ্রন্থের ইজ্জত দিতে জানে না, একজন বিধর্মীর কাছ থেকে সম্মান আশা করা যায়? বিচার যদি করতে হয় তাহলে হাশেম ডাক্তারের করতে হবে বলে তিনি বিচার সভা থেকে বের হয়ে গেলেন।চলবে