আমরা মানুষ সকলেই।। শাহনাজ পারভীন

খুব ছেলেবেলায় প্রায়ই মায়াময় সতেজ বিকেলে
বড় চাচীর হাত ধরে মধুমতির পাড় ঘেঁষা এবরো থেবরো পথে এলোমেলো ভাঙনে সাবধানী পা ফেলে চাচীর বাবার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। মধুমতির ঢেউ গুনতে গুনতে, পায়ের নীচের অমসৃণ পথ ভাঙতে ভাঙতে যখন আমরা নদী পাড়ের কাঞ্চনদের লেপা ডোয়া, নিকানো উঠোন, ফুটন্ত জবাফুল প্রাঙ্গণে আসতাম, তখন একটুখানি দাঁড়িয়ে প্রশান্তির হাফ ছাড়তাম আমরা। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতাম পথশ্রান্ত পথিকের মতো, প্রজাপতির সৌন্দর্যে চোখগুলো খেলা করতো থোকায় থোকায় ফোটা হাজার গোলাপ, খয়েরি গাদা ঝাড়, স্থলপদ্মের গোলাপি পাপড়িতে।

আবারো কয়েকদিন বাদেই আমাদের রাস্তা বদলে যেতো। বদলে যেতো অনবরত এভাবেই আমাদের পরিচিত পথ, বৃক্ষ, সভ্যতা এবং ক্ষয়িষ্ণু মানুষের দিনলিপি। মুহূর্তেই উদ্বাস্তু হওয়া একেকটি পাণ্ডব মুখ। রাস্তা বদলে গেলে বুকের মধ্যে হাফরের বাড়ি পড়তো দ্রিম দ্রিম। আহা! মধুমতি কেঁড়ে নিলো সবই! নিকোনো উঠোন, লেপা ডোয়া, সাজানো সংসার, সারি সারি মেহগনি, জবা, গাদার ঝাড় অনাবিল। লাউ মাচা, কাঁটানটে, কেড়ে নিতো ঋষি বট, কলাইয়ের সবুজ সতেজ মোলায়েম নাতিদীর্ঘ ক্ষেত, আম্রমুকুল, চালতার ছায়া ছায়া সোনালু সকাল। নারকেল, খেজুর, তালগাছের লম্বা সাড়ির মেঠোপথ।

সেই ছোটবেলা থেকেই কাঞ্চনের জন্য আমার মায়া।রুপমের জন্য পরান পুড়ে যায় যখন তখন।
শৈশরের স্কুল বেলায় কাঞ্চন আমার প্রিয় বান্ধবী।
কতদিন ওর হাতে হাত রেখে নদী ভাঙনের দুঃখ ভোলানোর চেষ্টা করেছি। বারবার ওর বঞ্চিত মনের পাশে সুখ হয়ে সাথে থেকেছি গোলাপের ঘ্রাণে সময়ের বিবর্তনে কত বন্ধু হারিয়ে গেছে, কিন্তু কাঞ্চন থেকে গেছে মনের গভীরে। তার নাম উঠে আসে কবিতার পাতায় পাতায়।

শ্রেণির শুরুতেই দুর্গা আমার ভালো বন্ধু। আজও আছে। কখনও মনে হয় নি দূর্গা শিকদার আর সাবিরা শওকতের মধ্যে পার্থক্য আছে এতটুকু। না ধর্মের না বন্ধনের! বন্ধু তো বন্ধুই আজীবন।

বড়দির অংক যাদু আমাদেরকে জড়িয়ে ধরতো প্রায়ই। কেউ না পারলেও জটিল অংকগুলো বড়দি করে দিতেন মুহূর্তেই। শেষ মুহূর্তে আমরা তার শরণাপন্ন হতাম নিশ্চিন্তে। সেও কেমন দূর্গা ভেবেই আদরে কাছে নিতো আমাদের।

কামারখালীর সুচিত্রা, রেখা আজও সাথে আছে তেমনি। এখনো কান পাতলেই সন্ধ্যার গান শুনি নিমগ্নতায়। রত্না, ফুলদি এখন দু’জন দু’দেশে।
তারপরও ফেসবুকে পাশে আছে যেনো; শেখর দা, বিনয় দা ছিলেন আমাদের কৈশোরের আপনজন। আজ অবধি শেখর দা সুখে দুখে সাথেই আছেন। কখনো মনে হয় নি, তিনি দাদা হন–ভাই নন কোনো।

গৌর স্যারের অংক ক্লাসে অজান্তেই একদিন ঢুল খেয়েছিলাম। তখন আমার যুদ্ধ সময়। মা চলে গেছেন। ছোট ভাইবোনদের নিয়ে হিমসিম খেতাম দিনরাত। স্যার বুঝতেন সবকিছু, মাথায় হাত রেখে পাশে এসে দাঁড়াতেন। জটিল অংকগুলো মুহূর্তেই পানি পানি যেনো! সুশীল স্যারের কবিতার ক্লাসে আমার যত্ন একটু বেশিই ছিল। তা নিয়ে লতিকার অভিযোগ কান পেতে শুনি। বড় দিদি মনি, গীতা দিদিমনি ছাড়া মাধ্যমিকের স্মৃতি বড় ফিঁকে। বড় এলোমেলো।

মায়ের মৃত্যুর পর বড় দিদিমনি আমাকে আদরে জড়িয়ে নিলেন তাঁর বুকে। মাতৃছায়া উথলে উঠতো মায়াভরা হৃদয়ে যখন তখন। তাঁর মুখে মায়ের ছায়া পেতাম। ভুলি নি এখনো। ভুলবো না আর।

ধ্যানেশ স্যারের ইংরেজি ক্লাস আজও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এই ডায়াসে তো চোখের পলকে তিনি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে। ইংরেজি ক্লাসে পাওয়া স্যারের উপহার ডিকশনারিটা এখনো সযত্নে সাজানো আমার। কতদিন মনে মনে স্যারের মতো শিক্ষক হতে চেয়েছি।

আমাদের শৈশবে, আমাদের কৈশোরে, আমাদের যৌবনে এবং বর্তমানের প্রতিটি ক্ষণে জড়িয়ে আছে তোমাদের প্রিয় সব নাম।

ড. তপন বাগচি, সৌমিত বসু, ফিলিপ বিশ্বাস, রীতা বিশ্বাস, অরুণ কুমার, সাধন দা, শ্রাবনী দিদি, বিপ্লবী দাস, পিয়া ম্যাগনোলিয়া, সর্বানী দত্ত, পদ্মনাভ অধিকারী, নীলকন্ঠ জয়, রাজপথিক, অনুসূয়া ঘোষ, দীপা মৈত্র, কবিতা মণ্ডল,
আরও কত কত নাম এখনো জড়িয়ে আছে হৃদয়ে সুনাম। নামের তফাত কোনো তখনো বুঝিনি, এখনো বুঝি না।

শুধু জানি, সৃষ্টির সেরা জীব আমরা মানুষ সকলেই।

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়