পথের কথা।। মাহমুদা রিনি

আজ বাড়ি থেকে আসছি, যশোর আসবো। গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের পথ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মনে হলো, লোকাল যে পরিবহন (তিন চাকার স্যালো ইন্জিন বিশিষ্ট) ঐটাতে চড়বো। বিকাল পাঁচটা বাজে, আকাশে মেঘ, বাড়ির কেয়ার টেকার ছেলেটা বার বার নিষেধ করলো, তবুও উঠে পড়লাম।

ছোট গাড়ী, ভিতরে চার-পাঁচজন নারী পুরুষ। তিনটা বাচ্চাও আছে সাথে, সবার কাছেই একটা করে পুটলি, কারো হাতে লাঠি, দেখে আন্দাজ করা যায় সবাই ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে ওদের মাঝে বসেছি, হাসি-হাসি মুখ করে ওদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টাও করছি, কিন্ত ওরা বেশ জড়োসড়ো,
আমার দিকে তাকাচ্ছেও না।

ঠিক আমার সামনে যে মহিলা বসা, তার বয়স বোঝা যাচ্ছে না, পঞ্চাশোর্ধ হবে। বেশভূষায় ঢাকাঢাকির বাহুল্য নেই, শক্ত পোড় খাওয়া চেহারা, তারপরও মুখে কেমন একটা মায়া মাখানো। আমার মনে হলো, ‘এ ভিক্ষা করতে পারে না’।

আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেই ফেললাম, ‘আপনার বাড়ী কোথায়?’
মহিলা একটু অবাক হয়ে উত্তর দিলো, ‘বারবাজার।’
আমি আবারো বললাম, ‘কোথায় গিয়েছিলেন এদিকে?’
স্বাভাবিক ভাবেই বললো, ‘সাপ ধরতে।’
এবার আমি চমকে উঠলাম, ‘মানে!’
যায়হোক আমি ঢোক গিলে উনাকে বললাম, ‘আপনি সাপ ধরতে পারেন?’
উনি বললেন, ‘হ্যাঁ’।
‘আজকে ধরেছেন?’
বললেন, ‘হ্যাঁ’।
‘কয়টা ধরেছেন?’
‘চারটা।’
‘আপনি নিজে ধরেছেন?’
‘হ্যাঁ, এরাও আমার সাথে ছিল–‘ বলে আরো তিন মহিলাকে দেখালেন। দেখলাম, সবারই কোলে বাচ্চা।
আমি ততক্ষণে শক্ত হয়ে গেছি। পুটলির দিকে তাকিয়ে গলায় জোর এনে বললাম, ‘সাপগুলো কোথায়?’
বললো, ‘আমার ছেলেকে দিয়ে আগে পাঠিয়ে দিয়েছি’।
‘কী করবেন সাপ দিয়ে?’
‘বিক্রি করবো’
সেইক্ষণে আবার সাপের জন্যও একটু মায়া হলো! আহা রে, বন বাঁদাড়ে সাপও নিরাপদে নেই, সর্বভূক মানুষের চাহিদার কাছে। এদের বলে লাভ নেই, এদের উপরে আরো অনেক বুভূক্ষ আছে।

যায়হোক, এতক্ষণে এরা আমার সাথে সহজ হয়ে এসেছে, বললো বাচ্চাদের নিয়েই সাপ ধরতে যায়। বাচ্চাগুলোকেও ক্ষুধার্ত মনে হলো। মহিলার ছেলে সাপ নিয়ে আগে চলে গেছে, বিক্রি করে খাবার কিনে আনবে। এরা বাড়ি যেয়ে রান্না করবে, তার পর রাতের খাবার। ওদের সামনে নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হল।ওদের কত কষ্টের অন্ন, যেটুকু অন্ন ওরা শরিরকে দেয়, শরির ফিরিয়ে দেয় তার বহুগুন। এইসব কথার মাঝখানে বৃষ্টি নামলো বেশ জোরে, বৃষ্টির ছাট লাগছে গায়ে। মহিলা আলতো করে আমাকে ধরে বললো, ‘মাগো এদিকে সরে আইসো, তুমি যে ভিজে যাচ্ছ’। আমি আর কথা বলতে পারছি না।

গাড়ি থামলো। ওরা জানে না আমি পথ চিনি। আমাকে বললো, ‘মাগো, এ গাড়ি আর যাবেনা, তুমি একটা বড় গাড়িতে উঠে চলে যাও, সন্ধ্যা নামছে, বৃষ্টি হচ্ছে, তুমি যে একা।’

আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। ভালই হলো বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির জলের সাথে মিশে চোখের জলটা ওরা দেখতে পেলনা।
‘মাগো, তুমি যে ভিজে যাচ্ছো, তুমি যে একা।’
শব্দ কয়টা বুকের মধ্যে নিয়ে আমি ফিরে এলাম, সারাপথ মনে হতে লাগলো–
জীবনে কত বড় বড় রুটে জার্নি করেছি, কত রোদ-বৃষ্টি, এমন করে কি কেউ বলেছে কখনো!!

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়