বকুল সই।। শাহনাজ শারমিন

শিশিরের দূর্বা ভেজা মেঠোপথের রাস্তা।বাবার হাত ধরে লাফাতে লাফাতে বেলা স্কুলে যাচ্ছে । ওর বয়স চার বছর, আজ ওর প্রথম স্কুল যাত্রা। কুঁকড়ানো কালো চুলে ঝুটি বাঁধা । সাদা একটা ফ্রক গায়ে দেখতে মনে হচ্ছে যেন সাদা পরী । এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হাসিতে গড়িয়ে পরছে। বাবা পরম যত্নে মেয়েকে আগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ।

বকুল গাছটা এক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে, ওদের চলার পথের দিকে। রাস্তা থেকে প্রায় পঁশিচ ত্রিশ গজ দুরে একটা বিশাল বড় পরিত্যক্ত ভিটা । সেই ভিটার ঢালে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে বকুল গাছটি।
বকুলের মনে খুব কষ্ট । সারা বছর কতো কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে অনেক যত্ন করে নিজের বুকে ফুল ফুটায় কিন্তু কেউ কখনো সেই ফুল তাকিয়েও দেখে না।
বকুল কিন্তু রোজই ছোট বড় অনেক লোকজনকে তাকিয়ে দেখে আর মনে মনে ভাবে এই বুঝি ওরা ফুল কুঁড়াতে আসবে কিন্তু না, প্রতি দিনই হতাশ হয়ে বকুলের দিন গড়িয়ে আবার রাত শুরু হয়। বেলাকে দেখে বকুলের খুব ভালো লাগে।তাই ওর চলার পথের দিকে তাকিয়েই থাকে আবার ফেরার অপেক্ষায়।এভাবে কেটে গেলো এক বছর।

এখন বেলা একটু বড় হয়েছে। ওর বাবা এখন আর ওর সাথে স্কুলে যায়না।ওর অনেক বন্ধু হয়েছে, তাদের সাথে বেলা স্কুলে যায়। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বেলা বন্ধুূদের বলে, এই দেখ অনেক সুন্দর গন্ধ নাকে লাগছে। বেলার সাথে থাকা মালা বলে, ‘হ, বকুল ফুলের গন্ধ। আয় মালা আমরা বকুল ফুল তুলে আনি।যেই কথা সেই কাজ।’ সাথে সাথে ওরা আট দশজন ঝুপঝাড় ভেঙে বকুল গাছের নিচে চলে গেলো। কুচরো ভর্তি করে ফুল কুড়াল সবাই। এবার বকুলের খুশি দেখে কে। বকুল যেন খুশিতে আত্মাহারা।

এভাবেই প্রতি দিন ওরা ফুল কুঁড়াতে যায়।এখন আর আগের মতো ঝোপঝাড় নেই।

একদিন বেলা দেখে গাছের তলাটা শুকনো। নিজের খাবারের পানির বোতল থেকে সবটুকু পানি গাছের গোড়ায় ঢেলে দেয়। তা দেখে মালা বলে, কী রে বেলা তুই গাছের গোড়ায় সব পানি ঢেলে দিলি কেন।
বেলা বলে, ‘শুনিসনি স্যার বলেছে গাছের জীবন আছে। ওদেরও খাবারের প্রয়োজন।’ বকুল মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘আহা আমার সাদা পরীটার আমাকে নিয়ে কতো ভাবে।’
প্রতি দিনের মতো আজও ওরা গাছ তলায় ফুল কুঁড়াতে যায় কিন্তু কোন ফুল না পেয়ে অভিমানে বেলা বলে, ‘ওগো বকুল সই তুমি আমার জন্য একটা ফুলও আজ রাখনি।’ বেলা মুখে সই কথাটা শুনে বকুল খুব খুশি হয়ে বাতাসকে বলে, ও বাতাস ভাই তোমার যত শক্তি আছে তাই দিয়ে আমার বুকে থাকা ফুলগুলো ঝরিয়ে দাওনা। বাতাস বকুলের কথা রাখে। টপটপ করে ঝরে পরে গাছের ফুল।বেলারা মনের আনন্দে ফুল কুঁড়াতে থাকে।

প্রকৃতির নিয়মে সময় গড়াতে থাকে। এখন বেলা দশ ক্লাসে পড়ে। পাশের বাড়ির রতন কলেজে পড়ে।বেলা যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলেই আবার কলেজও আছে। তাই দুজনে একাত্রই যায়।একদিন বেলা আর রতন দুজনে মিলে বকুল গাছের তলায় এসে বসে। ওরা ওদের মনের কথা বলে। বেলা বলে, ‘রতন আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবনা। বেলা আমিও তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। রতন,আমার বকুল সইকে সাক্ষী রেখে বললাম, তুমি আমাকে ভুলে গেলে আমি আত্মহত্যা করবো।’
রতন বেলার মাথাটা ওর বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে।
এভাবেই দিনের পর দিন কাটতে থাকে আর ওদের ভালোবাসা আরো গভীর হতে থাকে। বকুল ওদের সব কথার নিরব সাক্ষী হয়ে থাকে।

প্রতি দিনের মতো আজও ওরা কথা বলছে। এমন সময় হঠাৎ রতনের বাবা সাথে আরো পাঁচ ছয়জন এসে হাজির। রতনের বাবা এসেই বেলাকে বকুল গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধে। বেশ কয়েকটা চর থাপ্পড় মারে।ছেলেকেও মারে। খবর শুনে বেলার বাবা আসে। সাথে সাথে গ্রামের অনেক লোকজন। শুরু হয় তুমুল কান্ড।
রতনের বাবার অশ্রাব্য ভাষা সহ্য করতে না পেরে বেলার বাবা বকুল গাছের একটা ডাল ভেঙে বেলাকে হাতে পায়ে পিটাতে থাকে।

বেলার আত্মচিৎকারে চারপাশ ভার হয়ে উঠে। বকুল চিৎকার করে কেঁদে বলে, ‘আমার সইকে আর মের না।’ কিন্তু গাছের কথা কারো কানে পৌছায় না। ওরা টেনে হিঁচড়ে বেলাকে নিয়ে যাচ্ছে আর বেলা চিৎকার করে বলছে, ‘আমি রতনকে ভালোবাসি!’

রতন এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়।

চারিদিকে ফজরের আজান হচ্ছে। তখনো অন্ধকার কাটেনি। বকুল খেয়াল করলো বেলা এদিকে এগিয়ে আসছে। গাছ তলায় এসেই তরতর করে গাছের উপর উঠে বসলো। বকুল হটাৎ করে বেলাকে গাছে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। বেলা কোমরে গুজা দড়িটা বের করে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। কান্না জড়িত কন্ঠে বেলা বলে, ‘ও বকুল সই, তুমি তো জানো আমি রতনকে কতো ভালোবাসি। ওরা কেউ আমাকে আর রতনকে এক হতে দিবে না। রতনকে ছাড়া আমিও যে বাঁচতে পারবোনা। এই জীবনে আমি রতনকে পেলাম না, আরেক জীবনে আমি ওর অপেক্ষায় থাকবো তুমি ওকে বলে দিয়ো।’ কথা শেষ করে দড়ির আর একটা অংশ গাছের সাথে পেচিয়ে বেলা ঝুলে পড়লো।

বকুল চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর ওদিকে বেলা ছটফট করে হাত পা নাড়তে থাকে। একটা সময় বেলার ছটফটানি বন্ধ হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বকুল বুঝতে পারে ওর বেলা সই আর নেই। সেই থেকে আর বকুল গাছে কোন ফুল ফুটেনা।

প্রতিনিয়ত বকুল বেলার শোকে কাঁদে। এভাবে কেটে গেছে প্রায় তিন যুগ। তখন বেলা প্রায় দুপুর। হঠাৎ লাল রঙের একটা গাড়ি রাস্তার পাশে এসে থামে। কাঁচাপাকা চুলের মধ্য বয়সী একটা লোক সেই গাড়ি থেকে নেমে ঝোঁপঝাড় ভেঙে বকুল গাছের দিকে এগিয়ে আসে।
কাছে আসতেই বকুল চিনতে পারে রতনকে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে রতন।
‘ও বকুল সই, তোমাকে তো আমার বেলা বড্ড বেশি ভালোবাসতো। সেদিন তুমি কি আমার বেলাকে বাঁচাতে পারনি।’ বকুল তার কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে নীরবে কাঁদতে থাকে।

‘ও বকুল সই, আমার বেলা তোমাকে খুব ভালোবাসতো তাই এই বাগান বাড়িটা আমি কিনে নিয়েছি। তোমার কাছে একটা ঘর তুলে আমি বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবো। আজ থেকে তুমি আমারও বকুল সই!’

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়