জলপাই রঙ জামদানী

স্বপ্না ইসলাম ছোঁয়া

-বৌমা, আমাকে আর এক কাপ চা দেবে? দু’দিন ধরে গলার কাছে কী যেন একটা কুÐলী পাকিয়ে আছে! চা খেলেই একটু ভালো লাগে। কথাগুলো বলেই জামান সাহেব ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর টিভির রিমোটটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ এই চ্যানেল, ওই চ্যানেল ঘোরাঘুরি করে টিভিটা আবার বন্ধ করে দিয়ে বেড রুমে চলে গেলেন।
অসময়ে চায়ের কথা শুনে কাশফিয়া রীতিমতো চটে গেল। বেলা প্রায় পৌনে একটা, দুপুরের রান্না হচ্ছে, দুটো গ্যাস ওভেনই আটকানো।এই অবস্থায় ভদ্রলোক চা চেয়ে বসলেন! একেতো কাজের মহিলাকে ছুটি দেয়া হয়েছে, তার ওপর শাশুড়িও অনুপস্থিত। আগে তো শাশুড়িই এক হাতে সবটা সামলাতো, আজ দু’দিন ধরে কাশফিয়া রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়ে বুঝতে পারছে, রান্নাঘর সামলানো কতটা কঠিন।
শাশুড়ী একা হাতে সব কাজ নির্বিঘ্নেই করছিল, হঠাৎ করেই জ্বর, শ্বাসকষ্ট সাথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। টুকটাক ওষুধ খাচ্ছিল, কমার কোনও লক্ষণই নেই, বাধ্য হয়ে কাশফিয়ার স্বামী মানে জামান সাহেবের ছেলে শাহেদ হট লাইনে ফোন করে মায়ের হেলথ্ কন্ডিশন জানায়। ওরাই তিন চারজন এসে শাহেদের মা’কে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, আর শাহেদদের সবাইকে রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলে গেছে।
কোভিড-১৯ পজিটিভ সন্দেহে নিয়ে গেছে। শাশুড়ী চলে যাবার পর থেকেই কাশফিয়ার কাছে মনে হচ্ছে, শ্বশুর যেন আস্ত একটা আপদ, উনি সারা ফ্ল্যাট টই টই করে ঘুরবেন আর সবার মধ্যে ভাইরাস ছড়াবেন। শাশুড়ির যদি কোভিড পজিটিভ হয় তাহলে শ্বশুরেরও পজিটিভ আসবে। আর ভাবতে পারছে না সে! একটা ওভেন খালি করে চায়ের কেটলিটা বসিয়ে এককাপ চা বানিয়ে শাহেদের সামনে চায়ের কাপ ধরা হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল,এই চা’টা তোমার বাবাকে দিয়ে এসো। উনার ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খাওয়ার বাতিক নতুন করে তৈরি হয়েছে নাকি আগে থেকেই ছিল? উনি এইযে সারা ফ্ল্যাট টই টই করে ঘুরছেন,এটা দেখে তো তুমিও কিছু বলছ না?
শাহেদ বউয়ের এরূপ রাগ দেখে মিনমিনে কণ্ঠে শুধু বললো,

এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন? বাবা তো সব শুনতে পাবেন! কী ভাববেন বলো তো? তাছাড়া মা’র তো এখনও পজিটিভ রিপোর্ট আসেনি, আগেই এত ডেসপারেট আচরণ করার কোনও মানে আছে?

শুনলে শুনবে, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।যাঁর আক্কেল জ্ঞান কম তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়েই কথা বলতে হয়, যদি শুনে শুনেও একটু আক্কেল জ্ঞান হয়, আর কী! সাফ বলে দিচ্ছি, তোমার বাবাকে বলবে ঘরের এক কোণে থিতু হয়ে বসে থাকতে, আর তা-না হলে আমি বাবার বাসায় চলে যাব।কথাগুলো বলে কাশফিয়া রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
জামান সাহেব কাশফিয়ার সব কথাই শুনতে পেলেন, কিন্তু উনি কথাগুলো গায়েই মাখলেন না, নির্লিপ্ত ভাবে আলমারি খুলে প্রায় ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের টুকরো টুকরো জমানো স্মৃতিগুলো হাতড়ে হাতড়ে দেখতে লাগলেন। আলমারির ভাঁজে ভাঁজে পরম মমতা, আর ভালোবাসা লুকোনো। উনার স্ত্রী মিনা’র জিনিসপত্র রাখা কর্ণারের দিকে হঠাৎ নজর চলে গেল জামান সাহেবের। খুব বেশি কিছু নাই তাতে। এই ত্রিশ বছরের গুনে গুনে মাত্র ন’টা শাড়ি ভাঁজ করে রাখা আছে।এরমধ্যে দুটো শাড়ি বিয়ের সময় দেয়া হয়েছিল। একটা সোনালী জরির কাজে লাল কাতান, আরেকটা হলুদ রঙের সাধারণ তাঁতের শাড়ি। যদ্দুর মনে পড়ছে, গায়ে হলুদে দেয়া হয়েছিল তাঁতের শাড়িটা। জামান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বললেন, “মেয়েরা এইসব স্মৃতি জমিয়ে রেখে কী যে সুখ পায়,এটা শুধু তাঁরাই জানে।”
মিনা’র খুব শখ ছিল জলপাই রঙা একটা জামদানী শাড়ির। বেশ কয়েকবার জামান সাহেবকে বলেও ছিল, তাঁর শখের কথা,কিন্তু মিনার জানা ছিল না, জোড়াতালি দেয়া সংসারে বাড়তি শখ আহ্লাদ খুব একটা পূরণ হয় না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে মিনা’র করুণ মুখখানা, বেশ কয়েকবার কিছু টাকা জমিয়ে জামানকে বলেছিল, “আমি কিছু টাকা জমিয়েছি, বাকীটা ভরে তুমি আমায় একটা জামদানী কিনে দেবে?” জামান হুঁ, হাঁ ছাড়া আর কিছু বলেনি। এরপরই হয়ত ছেলের সেমিস্টার ফি, কিংবা মেয়ের কলেজ ফি, টিউশন ফি এসব দিতে গিয়ে জামানের হাত টান পড়েছে, তখনই সে মিনা’র জমানো টাকায় হাত বাড়িয়েছেন। মিনাও টুঁশব্দ করেনি, হাসিমুখেই টাকাটা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছে, “এবার আর শাড়ি কিনব না,এরপর সুযোগ পেলে একটা জামদানী কিনে দিও?” জামান সাহেবও ঘাড় কাঁত করে সম্মতি জানিয়েছেন। ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিল, বিয়ে করলো, মেয়েও অনার্স শেষ করে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল, মিনা’র সেই শখ আর পূরণ হলো না।
ড্রয়ার খুলে নিজের ওয়ালেটটা বের করলেন, পেনশনের টাকা থেকে কিছু টাকা অনেক দিন ধরেই ওয়ালেটে পড়ে ছিল, গুনে দেখলেন, তাতে তেরো হাজার ছয়শত চল্লিশ টাকা আছে। ওয়ালেটটা আগের জায়গায় রেখে আলমারি বন্ধ করে দেখলেন, ছেলে নিঃশব্দে এসে ওয়ার্ডরোব এর ওপর চায়ের কাপ রেখে গেছে।
পরদিন সকাল দশটার দিকে জামান সাহেব কাউকে কিছু না বলে ওয়ালেটটা পকেটে পুরে ডেমরার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। অঘোষিত লক ডাউন চলছে। রাস্তায় তেমন যানবাহন কিংবা মানুষজন নেই, পিকআপ ভ্যান, অটোরিকশায়, কিছুটা হেঁটে এভাবেই ডেমরা পৌঁছে খুঁজে খুঁজে কয়েকজন তাঁতিদের বের করলেন। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর জলপাই রঙা একটা জামদানী শাড়ি কিনেও ফেললেন। যদিও মিনা যে জলপাই রঙের কথা বলছিল,এটার রঙ তেমন না, এটা আরেকটু ডিপ, তবুও তো পেয়েছে, এটাই স্বস্তি।
মিনা’র রিপোর্ট হয়ত আসেনি এখনও, নইলে ওঁরা তো জামান সাহেবের কন্টাক্ট নাম্বার নিয়ে গেছে, রিপোর্ট এলে ফোন দিয়ে তো বলতো!যাক গে, রিপোর্ট যা-ই আসুক, সে কাল সকালেই মিনা’র কাছে ছুটে যাবে, হাতে থাকবে সেই জলপাই রঙের জামদানী শাড়ির প্যাকেটটা।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হলেন। শাহেদ, কাশফিয়া বারবার জিজ্ঞেস করছিল জামান সাহেবকে, কোথায় গেছিলেন তিনি, কোনও কথারই উত্তর দিলেন না সে। এই সংসারের জন্য যে মানুষটা নীরবে, নিভৃতে এতো শ্রম দিয়ে গেছে হাসিমুখে, সেই মানুষটাকে অদৃশ্য এক ভাইরাস খুব সহজেই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে, তা যেন ভাবতেই পারছেন না জামান সাহেব।

সারারাত শুধু মিনার কথাই ভাবলেন জামান সাহেব। চোখের পাতা কিছুতেই আজ এক হচ্ছে না। সকাল হলেই ছুটবেন হাসপাতালে। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন সে।হঠাৎ দেখতে পেলেন, ঝড়ে বিধ্বস্ত ক্লান্ত ভাঙাচোরা মুখটা নিয়ে মিনা চোখের সামনে এসে হাজির।তারপর অভিমানী গলায় বললো, 
– আমি তোমার কাছে একটা জলপাই রঙের জামদানী কিনে চেয়েছিলাম, তুমি শেষমেশ আমার জন্য সাদা জামদানী কিনে আনলে?জামান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন মিনার দিকে,তারপরই বললেন,- কোথায় সাদা শাড়ি? প্যাকেট খুলে দেখো, তোমার পছন্দের রঙই আছে।মিনা এক ঝটকায় প্যাকেটটা খুলে গায়ে মেলে ধরে বললো, – দেখো তো এটা সাদা কি-না? আমি কি মিথ্যে বলছি?
জামান সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, সত্যিই তো!!কোথায় জলপাই রঙ! সাদা জামদানীতে মিনার পুরো গা একদম ঢেকে আছে!