লকডাউন

অলিয়ার রহমান

সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বজলুর রহমান সাহেব বারান্দায় এসে বসলেন। আষাঢ় মাসে বৃষ্টি সাধারণত পনের থেকে বিশ মিনিট মুষলধারে হয়, তারপর সারাদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি লেগে থাকে। আজকের বৃষ্টির কোন মা-বাপ নেই। তিনি ভোর পাঁচটায় সময় ওঠে দেখেন বৃষ্টি হচ্ছে – সেই বৃষ্টি এখনো সমানতালে ঝরে যাচ্ছে। স্মরণকালে এমন বিরামহীন বৃষ্টি তার চোখে পড়েনি।

বজলুল রহমান সাহেব সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার। সারাজীবন সততার সাথে চাকরি করার ফল হিসেবে আজও ভাড়া বাসায় জীবন অতিবাহিত করছেন তিনি। তার সঙ্গে চাকরি করে অনেকেই ঢাকা শহরে দুই/তিনটা বাড়ি বানিয়েছেন। এনিয়ে বজলুল রহমান সাহেবের অবশ্য কোন আফসোস নেই। তিনি ছেলে মেয়ে দুটিকে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছেন। তার ছেলেটি সম্প্রতি মাগুরার শালিখা উপজেলায় ইউ এন ও হিসেবে যোগদান করেছে। মেয়েটি যশোর সিটি কলেজে বোটানির সহকারী অধ্যাপক । দুজনেই বি সি এস ক্যাডার। ঢাকা শহরে দুটো বাড়ি দিয়ে তিনি কি করবেন?

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খবরের কাগজ বিক্রেতা ফারুক এসে কাগজ দিয়ে গেল। রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। এই অবস্থায় সাইকেল ঠেলে ঠেলে ফারুক দরজার সামনে হাজির। বজলুল রহমান সাহেব বললেন – ” ফারুক মিয়া, তুমি তো অসাধ্য সাধন করে ফেললে! এই দূর্যোগের মধ্যে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়?”
” আপনার জন্যি আসলাম ছার । আমি জানি – আপনি কাগজের জন্যি বারান্দায় বসে আচেন।
” তাই বলে তুমি ভিজে ভিজে কাগজ দিতে আসবে?”
” ভিজিনি স্যার। আপনার দেয়া রেইন কোটটা পরে আইচি । জিনিস একখান দিছেন ছার। বাইরে ভিজে জবজবা , আর ভীতরে শুকনো খড়খড়া। নেন ছার- কাগজডা নেন।”
” বৃষ্টিতে ভিজে এসেছো, এককাপ চা খেয়ে যাও ফারুক মিয়া।”
” না ছার – আজকে থাক। বাজার করতি হবে। কালকেরতে হাবার লকডাউন। প্যাট তো আর লকডাউন বোঝবেনা। সময় মতো তারে চারডে না দিতি পারলি পা দুডো লকডাউন করে বসে থাকপেনে। আসি ছার।”

বজলুল রহমান সাহেব খবরের কাগজটা খুলে বসলেন। বড় করে হেডলাইন করেছে -” আগামী কাল থেকে সাত দিনের জন্য কঠোর লকডাউন।” লকডাউন “কঠোর” কেন ? এর গুরুত্ব বোঝাবার জন্য? কিন্তু মানুষ তো বুঝবে বলে মনে হয় না। এর আগেও বহুবার লকডাউন হয়েছে। প্রতিবারই অবস্থা দেখে মনে হয় – লকডাউনে মানুষের বাইরে যাবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এজন্যই লকডাউনকে কঠোর করা হয়েছে। আচ্ছা, লকডাউনের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য কি কি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে? তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসলেন এবং মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
১. লকডাউন।
২. সীমিত পরিসরে লকডাউন
৩.সর্বাত্মক লকডাউন।
৪. কঠোর লকডাউন।
তিনি আর কিছু মনে করতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন – ভবিষ্যতে লকডাউনের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য আর কি কি শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে? তিনি চিন্তা করে লিখলেন –
৫. মারাত্মক লকডাউন
৬. চরম লকডাউন
৭. আল্লার কিরে লকডাউন।
৮.-

” এ্যাই, তুমি বাজারে যাবে না?”
পিছনে নাহার এসে দাঁড়িয়েছে – হাতে বাজারের ব্যাগ। এই মানুষটা দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তার সুখ দুঃখের সাথী হয়ে আছে।
” বৃষ্টির ভিতরে বাজারে যাবো কিভাবে?”
” তাহলে থাক। তুমি সামনের মুদি দোকানে ফোন করে বলে দাও দশটা ডিম আর আধা কেজি রসুন দিয়ে যেতে। খামাকা বাইরে যাবার দরকার নেই। মেহেদী আর মিমি সারাদিন ফোন করে তোমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করছে।
” এক সপ্তাহ শুধু ডিম খেয়ে থাকবো?”
” শুধু ডিম খেয়ে থাকবে কেন? ভাত খাবে, ডাল খাবে।”
” ভাত খাবো, ডাল খাবো?”
” কেন – ভাত, ডাল তোমার কাছে খাবার মনে হচ্ছে না? মানুষ ভাত পাচ্ছেনা, আর উনি আছেন ডিম নিয়ে। আমার অবশ্য টেনশন হচ্ছে মিমিকে নিয়ে। গতকাল বলছিলো আজ বিকেলে আসতে পারে। ওর মেয়েটা আবার মুরগী ছাড়া কিছুই খায় না। আর যদি সাথে মোরশেদ আসে তাহলে তো উপায় নেই। জামাইকে তো শুধু ডিম দিয়ে ভাত দেওয়া যাবে না।”
” মিমি আসবে নাকি?”
” বলেছিলো তো আসবে। আকাশের যে অবস্থা – বাসা থেকে বের হতে পারলে হয়!”
” দাও – ব্যাগ দাও, বাজার করে আসি। বৃষ্টি আজ আর থামবে না। একে বৃষ্টি, তার উপর আবার সাঁকো পার হতে হবে।”
” সাঁকো পার হতে হবে মানে কি? সাঁকো কোথায় পেলে?”
” মোড়ের মাথায় বাঁশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করেছে না? সেখানে এখন পানি থইথই করছে। মনে হচ্ছে – নদীর উপর সাঁকো দিয়ে রেখেছে।”
” বেশি ঝামেলা মনে হলে আজ থাক।”
” রিটায়ার্ড করলেও আমি কিন্তু আর্মির লোক। এইটুকু ঝামেলা আমি নিতে পারবো। দাও – ব্যাগ দাও।”
বজলুল রহমান সাহেব প্যান্টের কাপড় হাঁটুু পর্যন্ত গুছিয়ে ছাতা মাথায় রাস্তায় নেমে এলেন। পুরো রাস্তা ফাঁকা। দুরে একটা রিকশা দেখা যাচ্ছে। তিনি ইশারা করে রিকশা ওয়ালাকে আসতে বললেন।
” একটু বড় বাজারে যাবো – তুমি যাবে?”
” জ্বি স্যার, উঠে বসেন।”
“রাস্তা কি খুলেছে?”
” জ্বি না স্যার, সামনের রাস্তা বন্ধ। আপনি উঠে বসেন, আমি অন্য রাস্তা দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবো।”
তিনি রিকশায় উঠে বসলেন। রিকশা ওয়ালা হুডের ভিতর থেকে একটা প্লাস্টিক বের করে ওনার পায়ের উপর বিছিয়ে দিয়ে বললো -” এটা একটু হাত দিয়ে ধরে রাখেন স্যার, না হলে প্যান্টটা ভিজে যাবে।”
রিকশা চলতে শুরু করেছে। ইঞ্জিন লাগানো রিকশা, তবুও মনে হচ্ছে – রিকশা ওয়ালার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তার পুরো শরীর ভেজা। একটু পরপর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি রিকশা ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন – তোমার কি শরীর খারাপ?”
” জ্বি স্যার, আকাশ পাতাল জ্বর।”
” কি সর্বনাশ, এই অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়েছো কেন?”
” কি করবো স্যার, দুই সপ্তাহ ধরে জ্বরে পড়ে আছি। ঘরে একদানা চাল নেই, দুই দিন ধরে বাসায় চুলা জ্বলছে না। মুদি দোকানদারও আর বাকি দিতে চাইনা। মেয়েটা তো আর এতোকিছু বোঝে না। কালকে সারাদিন মেয়েটা খাবার জন্য কেঁদেছে। তারপর রাতে একসময় না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে যাবার পর ওর মাথায় হাত রেখে আমি সারারাত কেঁদেছি আর আল্লাহর কাছে বলেছি – ” হে আল্লাহ পাক, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার জান-পাখিটার কষ্ট তুমি দুর করে দাও।”

বজলুল রহমান সাহেবের হঠাৎ তার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি নিজেও ছোট বেলায় দুইদিন না খেয়ে ছিলেন। তার বাবা ছিলেন হতদরিদ্র। অন্যের জমিতে কামলা খাটতেন। একবার শ্রাবণ মাসে প্রচন্ড জ্বর হলো বাবার। প্রায় একমাস হয়ে গেল – জ্বর সারে না। মা পড়ে গেলেন অকুল পাথারে। আমাদের কিছু হাঁস- মুরগি ছিলো – সেগুলো বিক্রি করে সংসার চলতে লাগলো। তারপর একটা পিতলের কলসি, দুইটা কাঁসার থালা বিক্রি হয়ে গেলো। এবং একসময় দেখা গেলো- বিক্রি করার মতো সংসারে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এরপর মা পড়ে গেলেন জ্বরে। সংসারে চুলা জ্বলে না। আমার বয়স তখন আট/নয় বছর। পৃথিবীর জটিলতা বুঝার মতো বয়স তখনও হয়নি। তিনি সারাদিন খাবার জন্য কান্নাকাটি করেন- খাবার মেলে না। পরদিন সকালে বাবা আমার মা’কে বললেন – “বউ, পুলাডার কষ্ট আর সহ্য হয়না। দেহি কোন কাজকম্ম জুটাতি পারি কিনা।” মা বললেন – ” তোমার এই শরীল নিয়ে কি কাজ করবা? নিজিই তো ঠিক মতো দাঁড়াতি পারতিছো না।”
বাবা বললেন -” এহন কুষ্টা কাটার সুমায়। দেহি কিছু করতি পারি কিনা।”
বাবা বেবিয়ে গেলেন। দুপুরের পরে কিছু লোক বাবাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এলো। বাবা পাট কাটার কাজে গিয়েছিলেন এবং কিছু সময় কাজ করার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সেই রাতেই বাবা মারা যান।

বজলুল রহমান সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি চোখ মুছে রিকশা ওয়ালাকে বললেন – ” তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে লেখাপড়া জানো, তাহলে রিকশা চালাচ্ছো কেন?’
” জ্বি স্যার , আমি ইংরেজিতে অনার্স করেছি। আমার দিনকাল এমন ছিলো না স্যার। আমি তিনটা কোচিং এ ইংরেজি ক্লাস নিতাম, ভালো বাসায় থাকতাম। গত দেড় বছর যাবৎ কোচিং বন্ধ। কিছু জমানো টাকা ছিলো, প্রথম দিকে সেই টাকা দিয়ে এটা সেটা করার চেষ্টা করলাম। কোন কিছুই প্রো পারলি হলো না। টাকা শেষ হলো। বউ-বাচ্চা নিয়ে বস্তিতে এসে উঠলাম। আর এখন তো না খেয়েই দিন পার করি।”
” তোমার মেয়ের বয়স কতো?”
” পাঁচ বছর । মেয়েটিকে অনেক আদর যত্ন দিয়ে মানুষ করেছি স্যার। ও খেতে শেখার পর বাসায় খাবার দাবারের কোন অভাব ছিলো না। সারাদিন চিপস্, চকলেট, এটা সেটা খেতেই থাকতো। আমার সেই মেয়েটা এখন সারাদিন ভাত খেতে পায় না – এ যে কি কষ্ট স্যার।” রিকশা ওয়ালা কাঁদছে। বৃষ্টির পানির সাথে তার চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। পৃথিবীটা বড় কঠিন জায়গা। এখানে চোখের পানি চোখ থেকে একবার ঝরে নীচে পড়লেই সেটা সাধারণ পানি হয়ে যায়। যতক্ষণ চোখে থাকে ততক্ষণই তার মূল্য। বজলুল রহমান সাহেবের পকেটে ফোন বাজছে। নাহার ফোন করেছে।
“হ্যালো।”
” এই, তুমি কি বাজারে পৌঁছে গেছো?”
” কেন – কি হয়েছে?”
” বাজার করতে হবে না। তুমি বাসায় চলে আসো।”
” বাজার করতে হবে না কেন?”
” মিমি আসতে পারবেনা। গতকাল সন্ধ্যায় ওর শ্বাশুড়ি এসেছে বাসায়। এদিকে মেহেদী আবার মাগুরা থেকে একগাদা মাছ কিনে ওর ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে বাসায়। আমরা দুইজন মাত্র মানুষ – এতো মাছ কে খাবে বলো? তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো।”
” আচ্ছা শোন – আমার একটু দেরি হবে। ঐ দিকটা তুমি সামলাও। আমি ফিরে এসে তোমাকে বলবো।”
রিকশা বড়বাজার কাছে চলে এসেছে। বজলুল রহমান সাহেব একটা পরিচিত দোকানের সামনে রিকশা রেখে বললেন -” তোমার নামটা শোনা হয়নি বাবা।”
” স্যার, আমার নাম ফয়সাল।”
“শোন ফয়সাল। তুমি দাঁড়াও, আমি তোমার সাথে আবার ফিরে যাবো। তোমার বাসা তো আমাদের এলাকায় তাই না?
” জ্বি স্যার। আপনাদের বাসার একটু সামনে ডানদিকের বস্তিতে আমার বাসা।”
” ওকে, এই দোকানদার তোমাকে কিছু বাজার দিবে। এগুলো রিকশায় আস্তে আস্তে উঠাও। সিটের খোলে জায়গা আছে না?”
“জ্বি স্যার।”
“ছোট ছোট মালগুলো সিটের খোলে রেখে দাও। আমি সামান্য বাজার করে আসছি।”
বৃষ্টি ঝরা বন্ধ হয়েছে। বজলুল রহমান সাহেব মুদি দোকানে ঢুকে একটা লিস্ট করে মালগুলো রিকশায় তুলে দিতে বললেন। তারপর তিনি চলে গেলেন বাজারের ভিতরে।
মালামালে ফয়সালের রিকশা পূর্ণ হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবলো – স্যারের বাসায় কতো লোক কে জানে? এই বাজার তো তিন মাসেও শেষ করা মুশকিল। চকলেট, চিপস, কুকিজ যে একসাথে এতোগুলা কেনা যায় – এই ধারনাই তার ছিলোনা।
বজলুল রহমান সাহেব বাজার করে রিকশার কাছে ফিরে এলেন। তার দুই হাত ভর্তি বাজার। ফয়সালের রিকশায় পা রাখার জায়গা নেই। তিনি আর একটা রিকশা ভাড়া করলেন। চাউলের বস্তা আর দুই ব্যাগ বাজার ভাড়ার রিকশায় তুলে দিয়ে তিনি পায়ের উপর একবস্তা চিপস নিয়ে ফয়সালের রিকশায় রওনা দিলেন বাড়ির দিকে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে তিনি বললেন – ” ফয়সাল, চলো তোমার মেয়েটিকে একটু দেখে আসি।”
” কি বলেন স্যার, আপনি যাবেন আমার মেয়েকে দেখতে?”
” হ্যাঁ যাবো। শোন – আমার মেয়েটার আজকে আসার কথা ছিলো। কিছুক্ষন আগে ফোন করে বলেছে সে আসবেনা। ওর একটা মেয়ে আছে ছয় বছর বয়স – নাম তিতলি। আমার সাথে দারুণ খাতির তিতলির। ও আসবেনা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে বুঝলে! তাই ভাবলাম – তোমার মেয়েটিকে একটু দেখে যাই। কি নাম তোমার মেয়ের?”
” স্যার ওর নাম রোদেলা – তার মায়ের দেয়া নাম।”
” চলো – রোদেলাকে দেখে যাই একবার।”
” বাজার গুলো রেখে আসি স্যার।”
” আরে চলোতে। যাবো আর আসবো। একবার বাসায় গেলে আমাকে আর আসতে দেবে না।”

বস্তি হলেও রিকশা দুটো ফয়সালের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। ফয়সালের শরীর টলছে। সে কোন রকম রিকশা থেকে নেমে কাঁপা গলায় বললো – রোদেলা মা, দেখো তোমার সাথে কে দেখা করতে এসেছেন। আসেন স্যার, ভিতরে আসেন।”
বজলুল রহমান সাহেব ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। খাটের উপর ২৫/২৬ বছরের একটা মেয়ে বসে আছে, তার বুকের উপর মাথা রেখে নির্বাক শুয়ে আছে রোদেলা। মেয়েটার চোখে জল। মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলেন তিনি। তার মনে হলো- তার মায়ের সাথে এই মেয়েটার চেহারার অদ্ভুত রকমের মিল আছে। তার মায়ের মতো এই মেয়েটার গায়ের রংও দুধে আলতা। সবচেয়ে বড় কথা – তার মায়ের মতো এই মেয়েটার ডানপাশের ঠোঁটে একটা লাল তিল জ্বলজ্বল করছে। বজলুল রহমান বললেন – “কেমন আছো মামনি? আমি তোমার মেয়ে রোদেলাকে দেখতে এসেছি।”
মেয়েটি কোল থেকে রোদেলাকে নামিয়ে দিয়ে বললো – “জ্বি ভালো, আপনি বসেন।”
তিনি বসলেন। তারপর ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন – ” ঐ রিকশা ওয়ালাকে বলো মালামালগুলো আস্তে আস্তে এই ঘরে ঢুকিয়ে দিতে।”
” বুঝলাম না স্যার।”
“তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না “- বলে তিনি নিজেই উঠে গিয়ে মালামালগুলো ঘরে ঢুকাবার ব্যবস্থা করলেন। ঘর ভর্তি হয়ে গেল মালপত্রে। তারপর তিনি মেয়েটির কাছে গিয়ে বললেন – ” মাগো, আজ আমি তোমাদের বাসার মেহমান। তোমাদের সাথে দুপুরে চারটে ভাত খাবো। অনেক দিন পোলাও খাওয়া হয়না। তুমি চটকরে একটু পোলাও আর মাংস রান্না করে ফেলোতো মা । খুব ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। ব্যাগের ভিতরে মাছ আছে। চার পিচ মাছও একটু ভাজি করে ফেলো। বুড়ো বাপ থাকার কি জ্বালা দেখেছো মা? ফট করে তোমাকে কেমন ঝামেলার ভিতরে ফেলে দিলো?”
মেয়েটি কোন কথা বলতে পারছেনা। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। সে অনেক কষ্টে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো – “আমি কি আপনাকে একটু পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারি বাবা?”
” বাপের পা ছুঁয়ে সালাম করবে – তার আবার অনুমতি লাগবে কেন মা?”
মেয়েটি বজলুল রহমানের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো, তারপর ওনার পাদু’টো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। বজলুল রহমান মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে বললেন – ” কাঁদো মা, কাঁদো। কেঁদে বুকটা হালকা করে নাও। এই পাথর বুকে চেপে থাকলে তুমি বাঁচতে পারবেনা। চোখের পানিতেই যে তোমার মুক্তি।”

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়