হঠাৎ বৃষ্টি

শহীদুল হক বাদল

(১)
অয়ন বনানীতে ঐ পাঁচতলার ছাদে সাতসকালেই পায়চারী করছিলো তখন। সোমা নামের ভয়ঙ্কর সুন্দরী মেয়েটি ওই বিল্ডিংয়েই দোতলায় তার খালার বাসায় বেড়াতে এসেছে সে গতকালই। তারও ঘুম থেকে খুব ভোরেই ওঠার পুরনো একটা অভ্যাস। দেখতে-শুনতে বেশ মায়াকাড়া চেহারাও পেয়েছে তার বাবার মতো। কিন্তু, তার মেজাজটা সবসময়ই থাকেও যেন বড্ডই খিটখিটে।
সেদিন ছাদে ওঠেই সে এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে শেষে এককোণে অয়নকে আনমনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনগুন সুরে গান গাইতে দেখেই সেও বেশ কৌতুহল নিয়েই তার কাছে গিয়ে নিঃসঙ্কুচে জিজ্ঞেস করলোও-
: এক্সকিউজ মি ভাই…! আপনিও কী এখানে বেড়াতে এসেছেন? কার কাছে শুনি, কয় তলায় ভাই? আর দেশের বাড়িইবা কোথায় আপনার। নেত্রকোণার ঐদিকে নয়তো আবার?

(২)
একসঙ্গে এতোগুলো প্রশ্নের প্রতিত্তোরে অয়ন কেবল বললো-
: নাহ…!
: তবে কী ভাই লজিং-টজিং থাকেন নাকি এখানে? বুঝলেন না বিষয়টাও- ঐ যে অনেকেই আছেওনা এমনটা যে, গাঁও-গেরাম থেকে ঢাকায় এসেই বড় লোকদের সেইসব বিচ্ছু টাইপের বাচ্চা-কাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ায়-টরায় এমনই আরকি।
: নাহ…!
: আরে ভাই, আপনার কী কোনো পীর-ফকিরের নিষেধ-টিষেধও আছে এমন যে, হ্যাঁ বা না ছাড়া আর কিছুই বলাও যাবে না মুখে খুলে কাউকে?
: আহ, কেন যে শুধু শুধুই বিরক্ত করছেন না এভাবে আমাকে? এতোসব না খুঁজে ছাদে ঘুরতে এসেছেন ব্যস ঘুরেন, নিজের মতো করেই। এই যে ম্যাডাম, সমস্যাটা কী আপনার বলেন তো শুনি?

(৩)
মেয়েটি তখন তার কন্ঠস্বরটি কিছুটা নরম করেই বললো-
: স্যরি ভাই…! আমি আবার বেশীক্ষণ কথাটথা না বলেও থাকতে পারিনা তাই। ও ভাই, আপনি কী কোনো কিছু করেন-টরেন নাকি। কালও তো দেখলাম যে, বেহুদাই ঘুরতেছেন এই ছাদে একাকীই। অন্যকোনো টেনশনেও আছেন নিশ্চই? নাকি চাকুরি-বাকুরি পাচ্ছেন না খুঁজে কোথাও। তাও অবশ্য ঠিক, এদেশে বেকারের সংখ্যাও তো বাড়ছে দিনদিন। বড় বড় নেতা আর আমলা কিংবা মন্ত্রীরাও তো দিব্যিই আছেন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে। ভাই, চাকুরীর চেষ্টা করতে থাকেন। চেহারা-সুরত দেখতেও তো হিরোর মতোই আপনার। হয়ে যাবে কোনো একদিন। এতোশত ভাইবেন না, ঐ যে উপরঅলাই এই গরীবদের শেষ ভরসা, কী বলেন?
: চাকুরী, এসব আমি হয়তোবা করবোও না কোনোদিন বুঝলেন? এই বাড়ির মালিকের একমাত্র ছেলেও আমি।
: ও বুঝেছি তাহলে। বড়লোকদের বাদাইম্যা পোলাপান থাকেও না এমন। মনে হয়, আপনার পড়াশুনার রেজাল্টও তেমনটা ভালোও না হয়তোবা। যাক, নিজের ঐ বড়লোক বাপের অঢেল সম্পদের উপর এখন বইস্যা বইস্যাই খান। রাজকপাল নিয়া জন্মাইলেই যা হয় মানুষের, সেইরকমই আরকি।
: প্লিজ, পরীক্ষায় আপনার রেজাল্টটা কী, ওটা কী একটু জানতে পারি আমি?

(৪)
বেশ ভাব নিয়েই মেয়েটিও তখন বললো-
: আমার রেজাল্ট অবশ্য বেশ ভালোই। অল্পের জন্য এ+ পাই নাই। একটু প্রেম-টেমের হালকা বিষয়াদিও ছিলো তো তাই, বুঝেনেই তো আজকালকার এই যামানায়। তবে, এইসব এখন মাথা থাইক্যা বাদ দিয়াও দিছি এক্কেবারে। শুনেন, আপনার গায়ে এইরকম যে ঢোলাঢালা গেঞ্জিটা পরছেন না, ওটা আমার একদম পছন্দও হয় নাই। নিজে একটু স্মার্ট থাকবেন সবসময়ই। নইলে, বিয়া-শাদীও তো করতে হবে আগামীতপ, নাকি? আইজকালকার মাইয়ারা কিন্তু বাইরের লেবাসটাই এখন বেশীও দেখে, বুঝলেন তো?
: বুঝলাম, আপনিও কী তাই দেখেন?
: না মানে…
: আরে এতোশত মানে-মানে কইরেন নাতো এখন। এমনিতেইতো মুখে খৈ ফোটেও দেখছি। হঠাৎ আবার লজ্জা পাওয়ার এমন কী হলো। শোনেন, আমার বাবার অঢেল সম্পদ এতোসব কে খাবেও বলেন? তাই গরীব মানুষদের মাঝে দু’হাতে কিছু বিলিবন্টনও করি আমি। এইগুলোতে ওদেরওতো হক আছে তাইনা। আমার বাবার অধিকাংশ অর্থকড়িই অবৈধ সম্পদও হয়তোবা। তবুও দেখি, অসহায় মানুষদের জন্য বড় ধরনের কিছু একটা করাও যায় কিনা। ও হ্যাঁ, আমি ঐ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় প্রথম হয়েই পাশ করেছি, গতবছর। তবে, সব ভাল ছাত্ররাই কিন্তু ভাল মনের মানুষও হয়না সবসময়। আপনি এও জানেন কী, এই বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছেনও যাঁরা তাদের অনেকেই দেখবেন শুরুতে ফেলটুস মার্কা ছাত্রও ছিলো প্রথম জীবনে অনেকেই। তাই, সার্টিফিকেট দিয়ে কেবল মানুষের মূল্যায়ন করাটাও বোধহয় সবসময় সঠিক হয় না, কী বলেন আপনি?

(৫)
মেয়েটি তখন নিমিলিত চোখের পাতায় মিনমিনে কন্ঠেই তাকে বললো-
: দুঃখিত। এবং খুব লজ্জিতও আজ আমি। না বুঝেই আপনাকে কতোকিছু বাজে বকলাম, ছি…! আমাকে আপনি তুমি বললেই খুব খুশী হবো।
: বেশ, তবে তাই হবে। ও হ্যাঁ আর একটা কথাও, আমার জন্য বাবা-মাও বিয়ের পাত্রী, মানে একটা সুন্দর মনের বউ খুঁজছেন। বলবো নাকি আজ তাদের, এই তোমার কথাটাও?
: বাহ রে, বিয়ে করবেন আপনি আর পছন্দওতো আপনার। তাতে আমিইবা কী জানি। আপনি নিজে যা ভালো বুঝবেন, তাই করবেন। আমার ওতে কোনো আপত্তিও নেই।
তখন আকাশের মেঘটা ঘন কালো হয়েই চারিদিকে দমকা হাওয়া ভেসে আসছে। হয়তোবা, রিমঝিম বৃষ্টিও নামবে শীতল-উষ্ণতায় গা ভিজিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পর…

সাহিত্য-ডেস্ক/আজ-আগামী/২০২১/০৮/০১/নী/জ@কপিরাইট_সংরক্ষিত

কবি নীলকন্ঠ জয়

সকল পোস্ট : নীলকন্ঠ জয়

মন্তব্য করুন